রচনাঃ চৈত্রের দুপুর


চৈত্রের দুপুর

ভূমিকাঃ  বাংলা বর্ষপঞ্জির শেষ মাস চৈত্র । মধুময় বসন্তকে সাথী করে তার আগমন। তবু ও তার মাঝে মিশে থাকে গ্রীষ্মের খরতা। চৈত্রের দুপুরে গগনের সূর্য যেন মাথার উপর থেকে অগ্নিবর্ষণ করতে থাকে। সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয় প্রকৃতির রুদ্রভাব। জীবন হয়ে ওঠে অতিষ্ঠ। দীর্ঘ অনাবৃষ্টিতে শস্যহীন শূণ্য চৌচির মাঠ, স্রােতহীন শীর্ণ নদী এবং বিরান মেঠো প্রান্তরে শুকনো পাতা আর ধূলিকণা হাহাকার উড়ে। একটু ছায়া সুশীতল, হিমেল পরশের জন্য মন তখন উন্মুখ হয়ে উঠে।

চৈত্রের দুপুুরে প্রকৃতিঃ চৈত্রের দুপুর থাকে রৌদ্রোজ্জ্বল । অনাবৃষ্টির আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে পড়ে। দিগন্তজোড়া মাঠ জ্বলে পুড়ে ফুটিফাটা হয়ে যায়। সে লক্ষ ফাটল দিয়ে ধরিত্রীর বুকের রক্ত নিরন্তর ধুঁয়া হয়ে উড়ে যায়। অগ্নিশিখার মাতো তাদের সর্পিল ঊর্ধ্বগতির দিকে চেয়ে থাকলে মাথা ঝিমঝিম করে । যেন নেশা লাগে। তাই চৈত্রের দুপুর সম্পর্কে কবি বন্দে আলী মিয়ার উচ্চারণ-

“চৈত্র মাসের দুপুর বেলা- আগুন হাওয়া বয়। দস্যি ছেলে বেড়ায় ঘুরে- সকল পাড়াময়। রোদের আঁচে পুড়ছে মাটি- উড়ছে ধুলোবালি। চারিটি দিক করছে ঝাঁ ঝাঁ- আকাশ হলো কালি”

চৈত্রের দুপুর চিরকালই দুর্বিষহ। সূর্য তখন ভীষণ রুদ্ররোষে ফেটে পড়ে ধুলার ধরণীতে । সৃষ্টিতে তন্দ্রার আবেশ ভেঙ্গে দেয়ার জন্যই যেন প্রকৃতির এই রুদ্ররুপ। সর্বত্র বিরাজ করে একরশ নিস্তব্দতা । কোথা ও কোনো সড়াশব্দ নেই। খোলা মাঠে লোক চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায় । জীবনের সর্বত্র কেবল তৃষ্ণা ।

চৈত্রের দুপুরে ফসলের অবস্থাঃ চৈত্রের দুপুর ফসলের জন্য অভিসাপ হয়ে দেখা দেয়। প্রচন্ড রোদে মাটি শুকিয়ে ফেটে যায়। কোথা ও মেঘের ছায়াটুকু পর্যন্ত নেই, অনাবৃষ্টির আকাশ যেন আগুন ঝরে পড়ে। নদী ,নালা খাল- বিল, পুকুর- ডোবা শুকিয়ে যায়, পানির অভাবে হাহাকার উঠে কৃষকের মাঝে। ব্যাপক ফসলহানিতে কৃষককুল হয়ে পড়ে দিশেহারা। চৈত্রের দুপুর গ্রাম:- চৈত্রের দুপুরে সবচেয়ে বিপাকে পড়ে বনের পশুপাখি। প্রখর তাপে মাঠঘাট জলশূণ্য ও শস্যহীন হয়ে পড়ায় পশুপাখিরা তাদের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাবার ও পানীয় জলের অভাবে হাড্ডিসার ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে । বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ চৈত্রের দুপুরে পশুপাখি অবস্থা বর্ণনা করেছেন মধ্যাহু কবিতায়-

“বেলা দ্বিপ্রহর। ক্ষুদ্র শীর্ণ নদীখানি শৈবালে জর্জর স্থির স্রােতহীন। অর্ধমগ্ন তরী’ পরে মাছরাঙ্গা বসি, তীরে দুটি গরু চরে শস্যহীন মাঠে। শান্তনেত্রে মুখ তুলে মহিষ রয়েছে জলে ডুবি। নদীকুলে জনহীন নৌকা বাঁধা। শূর্ণঘাট- তলে রৌদ্রতপ্ত দাঁড়কাক স্নান করে জলে পাখা ঝটপটি।”

চৈত্রের দুপুর গ্রামঃ  চেত্রের দুপুরের দাবাদাগে গ্রাম্যজীবন অতিষ্ট হয়ে ওঠে। ছেলে- বুড়ো সবাই তখন ভিড় জমায় পুকুর, নদী এবং দীঘির পানিতে। পানির মাঝে দাপাদাপি করে সবাই শান্তি পেতে চায়। প্রখর রৌদ্রতাপে তখন পানি ও গরম হয়ে যায়। তথাপি জীবনের একমাত্র স্বাদ যেন পানিতেই। চেত্রের দুপুরে কেউবা ঘর্মাক্ত শরীরে নিয়ে বসে থাকে গাছের ছায়ার। কেউবা ঘরের পাটি- মাদুর নিদ্রা যায়। রমণীরা পাখা নাচাতে ক্লান্ত হয়ে যায়। ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা বৃষ্টির গান গেয়ে বেড়ায়- “ আল্লা মেঘ দে ছায়া দে রে তুই।

চৈত্রের দুপুরে শহরঃ  চৈত্রের দুপুরে শহরের বিলাসবহুল আয়েশি জীবনযাপনের ও ছন্দপতন ঘটে। তখন খাওয়া দাওয়া ও ভালো লাগে না। বিওবানেরা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিন কক্ষে শান্তির সন্ধান করে। রাস্তাঘাটে, গাড়িতে ফেরিওয়ালা নানা ধরনের পানীয় বিক্রি করে। দোকানে ডাব, শরবত বিক্রির ধুম পড়ে যায়। ক্লান্ত পথিক কোথা ও পানি পেলে যেন বেঁচে যায়। শহরের বস্তি বা ঘিঞ্জি এলাকাগুলোর গুরিব মানুষের জীবন হয়ে উঠে অসহনীয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়-

 “চৈত্রের দহময় দুপুর প্রচন্ড খরা আর দহজ্বালায় ভরপুর, দুপুরের রৌদ্রময়তা করে না মোর সাথে সখ্যতা”

চৈত্রের দুপুরের আনন্দঃ  চৈত্রের দুপুরের কষ্ট যতই দুঃসহ হোক না কেন, তার মাঝে জীবনের আনন্দ কম নেই। নিদাঘ দুপুরে যখন কোকিলের কহু কহু ডাক কানে ভেসে আসে, তখন মনে এক বাসন্তী আমেজ অনুভূত হয় । প্রখর তাপে শরীর মন যখন দুগ্ধ, পানিতে নেমে মানুষ তখন মনে দাপাদাপি করে এক স্বর্গীয় আনন্দ উপভোগ করে। সংসারী মানুষটি ও যখন কাজের অবসরে একটু শীতল পানীয় পান করে অথবা ছেলেমেয়েদের নিয়ে তরমুজ, ফুটি ভাগ করে খায়, তখন জীবন সত্যিই আনন্দে ভরে উঠে। কোনো এক চৈত্রের দুপুরের বর্ণনা কবি এভাবে দিয়েছেন-

“জনশূণ্য পল্লিপথে ধূলি উড়ে যায় মধ্যাহৃ বাতাসে। স্নিগ্ধ অশরের ছায় কান্ত বৃদ্ধা ভিখারিনি জীর্ণ বস্ত্র পাতি ঘুমায়ে পড়েছে, যেন রৌদ্রময়ী রাতি ঝাঁ ঝাঁ করে চারদিকে নিস্তব্ধ নিঝুম..। ”

চৈত্রের দুপুরের হঠাৎঃ  চেত্রের দুপুরে মানুষ ও পশুপাখি সবাই তীব্র গরমে অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। কিন্তু মাঝে মাঝে বৃষ্টি শান্তির বারতা নিয়ে আসে। মাঠ- ঘাট সবকিছু সজীব হয়ে ওঠে। ছেলে বুড়ো সবাই বৃষ্টি পানিতে ভিজে আনন্দ পায়। তাদের জীবনে নেমে আসে শান্তির পরশ। পশুপাখি যেন জীবন ফিরে পায়। চৈত্রের দুপুরের এ বৃষ্টি বেশিক্ষণ স্থায়ী হয় না। কিন্তু এটি কৃষক সহ সকলের মনে প্রাণে আনন্দের দোলা দিয়ে যায়।

উপসংহারঃ  চৈত্রের দুপুরে একরাশ নিস্তদ্ধতা থাকে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা যেন থমকে যায়। গরমের তীব্রতা সহ্য করতে না পেরে মানুষ তখন কেবলই কাতরায় । সূর্য তখন যেন থমকে যায়, মানুষ তবু আশা হারায় না। আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি কামনা করে আর এ কষ্টকর জীবন থেকে পরিত্রাণের প্রহর গোনে।

রচনাঃ জনসেবা 
Previus
রচনাঃ ইন্টারনেট অথবা, বিশ্ব যোগাযোগে ইন্টারনেটের ভূমিকা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম