রচনাঃ জনসেবা 


জনসেবা

ভূমিকাঃ মানুষ সৃষ্টির সেরা জীবন হিসেবে মানুষের প্রতি মানুষের কর্তব্যবোধ থেকেই জনসেবা প্রত্যয়টির উদ্ভব হয়েছে। মানুষের রয়েছে বিবেক, বুদ্ধি মানবতাবোধ ইত্যাদি গুন।আর এ কারনেই মানুষ সমাজ পরস্পর মিলেমিশে বসবাাস করে। এ জন্য মানুষকে সমাজ বদ্ধ জীব বলা হয়। সমাজে বাস করতে গেলে পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীলতা সহযোগিতা ও সহমর্মিতা একান্ত জরুরি। মানুষ সমাজে সংঘবদ্ধভাবে বাস করতে গিয়ে একে অপরের কল্যাণে এগিয়ে এসে নিজেদেরকে জনসেবায় ব্যাপৃত রাখে।


জনসেবার স্বরুপঃ জনসেবা বলতে বোঝায় মানুষ কর্তৃক মানুষের সেবা। মানুষের মহৎ গুন হলো তার মনুষ্যত্ব। গুনের বশবর্তী হয়েই মানুষ পরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত করে। আত্মস্বার্থ ত্যাগ করে পরের কল্যাণে ব্রতী হওয়াই জনসেবার মূল উদ্দেশ্য । মানুষের উপকার সাধনের মাধ্যমেই জনসেবার অংশ নেওয়া যায়। মানুষের দুঃখ বেদনা সহমর্মিতা প্রকাশ করে মানুষ যখন একে অপরের উপকারে নিয়োজিত হয়, তখন তাকে বলা যায় জনসেবা। আত্মস্বার্থকে প্রাধান্য না দিয়ে পরের জন্য কিছু করাই জনসেবা বলে পরিচিত। আত্মসুখে মগ্ন না হয়ে মানুষ যদি তার চারপাশের মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে, তাহলে তার মধ্যে এ মহৎ গুনের পরিচয় মিলে। জনসেবার মাধ্যমেই মানুষ তার মহওে¦র পরিচয় দিয়ে থাকে। এ মহৎ কর্ম সাধনের মাঝে চিওে যে প্রশান্তি আসে তা মানুষকে সকল কলুষতা থেকে দূরে রাখে। জনসেবা করলে পরম করুণাময়ের সন্তুষ্টি লাভ করা যায় এবং মানুষের জীবন সুন্দর ও সার্থক হয়। এক অদ্ভুত ভালোলাগা কাজ করে জনসেবায় ব্রতী মানুষদের হৃদয়ে । তাই তো কবি বলেছেন-

“পরের কারণে স্বার্থ দিয়া বলি এ জীবন মন সকলি দাও তাহর মতো সুখ কোথা ও কি আছে আপনার মতো ভুলিয়া যাও।”

জনসেবার পদ্ধতিঃ জনসেবা মানুষের স্বেচ্ছাকর্ম । তবে কোনো একটি নিদিষ্ট সমাজের জন্য জনসেবার পদ্ধতি কী হবে বা হাওয়া উচিত এ সম্পর্কে কোনো দিক নির্দেশনা দেয়া সম্বব নয়। সময়, স্থান ও জনগণের প্রয়োজন বুঝেই এ পদ্ধতি নির্ধারণ হয়। যেমন-  দরিদ্রকে বছরে একবেলা পেট ভরে খাওয়ানো বা কাউকে একটা বস্ত্র দান করা বা কার ও চিকিৎসায় কিছু অর্থ দান করা ইত্যাদির মধ্যে জনসেবার পদ্ধতি সীমাবদ্ধ নয়। বরং কোনো মহৎগুন ব্যক্তি যদি আত্মসুখের মোহ বাদ দিয়ে সমাজের মৌলিক কল্যাণ চিন্তা করে কাজ করেন, তবে তার কাজই হচ্ছে জনসেবা। জনসেবার প্রকৃত মূল্য শুধু অর্থ বা সম্পদ দানের মধ্যেই সীমিত নয়। এর ক্ষেত্রে আর ও ব্যাপক ও বিস্তৃত। এ ক্ষেত্রে যদি একটি কিশোর ছেলে ভিক্ষা করে খায় তবে তবে তাকে ভিক্ষা না দিয়ে যদি কোনো কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া যায়, তাহলে এটাই হবে প্রকৃত জনসেবা । যেমনটি হাজী মোহাম্মদ মুহসীন করেছিলেন। তিনি একটি চোরকে স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য কিছু অর্থ দিলেন। চোরটি চুরি ছেড়ে দিল এটিই প্রকৃত জনসেবার উদাহারণ । আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স) একদিন এক ভিক্ষুককে তার বাড়ি থেকে কম্বল নিয়ে আসতে বললেন এবং তা বিত্রি করে তাকে কিছু টাকা দিলেন। এ অর্থ দ্বারা কুঠার কাঠ কেটে সংসার চালাতে বললেন। এটাই জনসেবার উৎকৃষ্ট পদ্ধতি । তবে কে, কোন পদ্ধতিতে জনসেবায় আত্মনিয়োগ করবেন, সেটা বড় কথা নয় বরং জনসেবায় ফলে সমাজ কতখানি উপকৃত হচ্ছে তাই উপলব্ধির বিষয়। অধ্যাপক রাস্ফিন মানুষের কর্তব্য কর্মকে তিনটি ক্ষেত্রে প্রায়োগিক বলে মনে করেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন “Duty towards God, Duty towards parents and Duty towards mankind”.  সুতরাং বলা যায়, নিদিষ্ট কোনো পদ্ধতির সাহায্যে জনসেবা করা যায় না। জনসেবার জন্য নানা পদ্ধতির রয়েছে । ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন দ্বারা জনসেবার মতো মহৎকর্মে শরিক হওয়া যেতে পারে। তাই বলা যায়, জনসেবার পদ্ধতি নির্ভর করে মানুষের ক্ষমতা, মন, মনন ও দৃষ্টিভঙ্গির উপর।

জনসেবার গুরুত্বঃ জীবনের সুন্দর বিকাশের জন্য জনসেবায় মাধ্যমে অনুকুল পরিবেশ গড়ে উঠে। কারণ জনসেবার মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয় ভালোবাসার অকৃত্রিম বন্ধন। জনসেবার কল্যাণ চিন্তাকে কাজে লাগিয়ে সমাজ থেকে শ্রেণিভেদ দূর করতে পারে মানুষ । ধনী দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে, নিচুস্তরের মানষগুলো জীবনযাত্রার পরিবর্তন সাধন করে দেশকে কল্যাণের পথে এগিয়ে নিতে জনসেবার বিকল্প নেই। জনসেবা করলেই দরিদ্র ও অসহায় মানুষগুলো জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। তাই সমাজ, উন্নতি কল্পে জনসেবার গুরুত্ব অত্যাধিক। জনসেবা শ্রেষ্ঠ ধর্মঃ র্কমই ধর্ম, র্ধমই জীবন। জনসেবার মধ্যেই মানবধর্ম স্বীকৃত । মানব সেবার মধ্যেই ঈশ্বরের সেবা নিহিত। কারন প্রতিটি জীবের মধ্যেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিদ্যমান। মানুষকে অবজ্ঞা করে ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করা যায় না। তাই তো স্বামী বিবেকানন্দন বলেছিলেন –

“জীব প্রেম করে যেইজন সেইজন সেবিছে ঈশ্বর।”

প্রতিটি ধর্মগ্রন্থেই জনসেবাকে শ্রেষ্ঠ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। স্রষ্ট্রার সন্তুষ্টি লাভ করাই মানুষের মূল উদ্দেশ্য । আর মানব বা জনসেবার মাধ্যমে এ সন্তুষ্টি অর্জন করা সম্ভব। কেননা “সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই ” এ সত্যকে উপলব্ধি করেই জনদরদি মানুষ মানব সেবায় তাদের জীবন উৎসর্গ করেন এবং এটাকেই তারা শ্রেষ্ঠ উপাসনা বলে মনে করেন। জনসেবার আদর্শ ঃপৃথিবীর সকল মহামানবের জীবনী পাঠ করলেই দেখা যায় যে, তাঁরা সকলেই মানবদরদি ছিলেন। জনগণের কল্যাণের জন্য তাঁরা হাসিমুুুখে জীবন দান করেছেন। যেমনঃ- মানবতার মুক্তির দূত, সর্বকালের সর্বশ্রেণ্ঠ মহামানব হযরত মুহাম্মদ (স)- এর চেয়ে আর কোনো বড় দৃষ্টান্ত হতে পারে না। ঈশ্বর পুত্র যিশু মানব কল্যাণের জন্য ক্রুশে জীবন দান করেন। ভগবান বুদ্ধদের মানব সাম্রাজ্য, সুখ, ঐশ্বর্য, মাতাপিতা, স্ত্রী পুত্রের বন্ধন ছিন্ন করে মানবকল্যাণের পথে বের হয়েছিলন। মাদার তেরেসা তার স্নেহের পরশ দিয়ে সুস্থ করে তুলেছিলেন শত সহস্র অসহায় ও দুস্থ মানুষকে । ক্রিমিয়ার যুদ্ধে আহত সৈনিকদের সুস্থ করে তুলতে এগিয়ে এসেছিলেন সেবাপরায়ণা আরেক নারী ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল। এভাবেই জনসেবায় আত্মনিয়োগ করে ইতিহাসের পাতায় স্থান করে নিয়েছেন এ মহামানবেরা।

কৈশোর বা ছাত্রজীবনে জনসেবা শিক্ষাঃ  জনসেবা একটি মহৎ গুন। এ মহৎ গুনের মাহত্মা উপলব্ধি করার প্রকৃত সময় হল ছাত্র জীবন বা কৈশোর। অপরের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রাখার মাঝে যে সুখ নিহিত , তার সন্ধান লাভে ছাত্ররাই সবচেয়ে বেশী উদ্বুদ্ধ হয়। তাই ছাত্রজীবনই প্রকৃত সময় যখন জনসেবা সঙ্গে তাদের সর্ম্পক স্থাপন করার উদ্যোগ নিতে হয়। এ গুন অর্জনের জন্য কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রয়োজন হয় না । তবে শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলো এ গুন অর্জনে ছাত্র ছাত্রীদের যথেষ্ট সহায়তা করতে পারে। যেমন বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য সেবাব্রতী দল রয়েছে। অগ্নিকান্ড, বন্যা,ঘূণিঝড়, মহামারী, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ ও সংকটের সময় কী ভাবে জনগণের সেবা করা যায় তা এ সংগঠনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে শিক্ষা দেয়া হয়। ফলে তারা কিশোর বয়স থেকেই জনকল্যাণে ব্রতী হওয়ার শিক্ষা লাভ করে। এরাই দেশ ও সমাজের ভবিষ্যৎ কর্ণধার। জনসেবার মূলমন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে পরবর্তীতে এরাই স্বদেশের উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করতে পারে এবং মানুষের জীবন যাত্রার পরিবর্তনে সাধনে এগিয়ে আসতে পারে। তাই বলা যায়, ছাত্রজীবনই জনসেবা সম্বন্ধে শিক্ষা লাভ করার উৎকৃষ্ট সময়।


বিশ্বব্যাপী জনসেবামূলক সংগঠন ও তাদের ভূমিকাঃ  মানবতার সেবা ও কল্যাণের জন্য আজ বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। পৃথিবীজুড়ে মানবসেবার পতাকা উড়াতে Red crescent society, UNICEF, UNESCO  প্রভৃতি সংস্থার অবদান অনস্বীকার্য । এসব আর্ন্তজাতিক সংস্থা, দেশের মধ্যকার বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি সংস্থা এবং এনজিওসমূহের বিভিন্ন দেশের দুঃসময়ের এবং দেশের অভ্যন্তরে কোনো দুর্যোগ , যেমন যুদ্ধ, বন্যা, ঘূণিঝড়, মহামারী, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদিতে এগিয়ে আসে। এভাবে জনগণের সেবা করার চেতনা দিন দিন বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধি পাচ্ছে।

উপসংহারঃ এ বিশ্বজগতে সকল ধর্মেই জনসেবার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আত্মসুখ বা আত্মভোগে কোনো মহত্ব নেই। অপরের কল্যাণেই নিহিত থাকে অপার্থিব সুখ। একমাত্র জনকল্যাণের মাধ্যমেই প্রকৃত সফলতা অর্জন করা এবং মনুষ্য জীবনকে অর্থসহ করে গড়ে তোলা সম্ভব । আর এ জনসেবাই প্রকৃত ধর্ম। তাই প্রত্যেকেরই জনসেবায় ব্রতী হওয়া উচিত।

রচনাঃ পল্লি উন্নয়ন
Previus
রচনাঃ চৈত্রের দুপুর
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম