রচনাঃ ইন্টারনেট অথবা, বিশ্ব যোগাযোগে ইন্টারনেটের ভূমিকা


ইন্টারনেট অথবা,
বিশ্ব যোগাযোগে ইন্টারনেটের ভূমিকা

ভূমিকাঃ  মানব সভ্যতার কোনো আকে মাহেন্দ্রক্ষণে বিজ্ঞানের যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল, সে অগ্রযাত্রা আজ চরম সার্থকতা ছোঁয়া পেয়েছে। শুরু থেকে অদ্যাবধি বিজ্ঞান মানুষকে যা কিছু দিয়েছে তন্মধ্যে শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ ইন্টারনেট। এটিমানুষের জীবনে চলার পথকে অভাবনীয় রূপে সহজতার করে তুলেছে। অধুনা যোগাযোগ ব্যবস্থায় ইন্টারনেট এক যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে। ইন্টারনেটের বাহ্যত তেমন কোনো সীমা নেই। এর দ্বারা প্রায় সবকিছুই সম্ভব।

ইন্টারনেটঃ  ইন্টানেট একক কোনো বিষয় নয, এটি একটি জটিল সমন্বিত বিষয়। ইন্টারনেট হলো “International Computer Network Service ” অসংখ্য নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত বিশ্বব্যাপী সুবিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্জ। অর্থাৎ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ব্যবহৃত কম্পিউটারকে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে যুক্ত করে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা ই ইন্টারনেট। অন্যভাবে বলা যায়, ইন্টারনেট হলো কম্পিউটারের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক । ব্যক্তিগত বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কম্পিউটার ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে অতি দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন এবং ছবিসহ যাবতীয় তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। তাই সারা বিশ্বের অগনিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সংবাদ সংস্থা, গবেষণাগার, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানসহ কোটি কোটি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেটে যুক্ত হয়ে এ মহাযোগযোগ গড়ে তুলেছে। ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত যেকোনো প্রতিষ্ঠান বিশ্বের যেকোনো স্থান থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।

ইন্টারনেটের উৎপত্তিঃ  ইন্টারনেট বিজ্ঞানের আধুনিক আবিষ্কার। এটি ১৯৯০সাল থেকে ব্যঅপভাবে ব্যবহৃত হলেও এর প্রকৃত যাত্রা শুরু হয ১৯৬৯ সালে। এসময় আমেরিকর প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ হাইড্রোজেন বোমার ভয়ে পেন্টাগনে কম্পিউটার থেকে কম্পিউটারে তথ্য আদান-প্রদনের জন্য টেলিফোনের বিকল্প সংযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলে, যা  “Advance Research Projects Agency Network (ARPAnet)”  নামে পরিচিত। শুরুতে বিষয়টি প্রতিরক্ষার সাথে যুক্ত থাকলেও কালক্রমে তা আমেরিকার বিভিন্ন গবেষনাগার ও বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষকগনের পরস্পরের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে হয়ে দাঁড়ায়। এমনকি তারা এ নেটওর্য়াকের মাধ্যমে একজন অন্যজনের কম্পিউটারের রক্ষিত প্রোগ্রাম বা সফটওয়্যার হয়ে চালাতে সক্ষম হয়। জরে ডেক্সটপ কম্পিউটার তৈরির পর টেলি-নেটওয়ার্কের সঙ্গে টেলিফোন সেটের বদলে কম্পিউটার জুড়ে দেওয়া হয়। কৃত্রিম উপগ্রহের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যপক পরিবর্তন আসে। ১৯৮৪ সালে ডাইরেক্ট ব্রড কাস্টিং স্যাটেলাইট সিস্টেম চালু হয। ফলে ইন্টারনেট যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেক দূর এগিয়ে যায়। সত্তরের দশকে কম্পিউটার থেকে কম্পিউটারে চিঠিপত্র আদান-প্রদান নিয়ে ই-মেইল চালু হয়। পরবর্তীতে অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের বিস্তৃতি ও স্যাটেলাইট টেলিযোগারেযাগ ব্যবস্থায় বদৌলত ইন্টারনেট্রে সাহায্যে দুই প্রান্তে কম্পিউটারের মাধ্যমে যোগাযোগ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ইন্টারনেটের সম্প্রসারণঃ  আমোরিকার প্রতিরক্ষা কর্তৃপক্ষ চারটি কম্পিউটারেরে মাধ্যমে যে যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করেছিলো তার নাম ছিল ‘ডার্পানেট’। পরবর্তী তিন বছরে কম্পিউটারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ছত্রিশে এসে দাঁড়ায়। চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ১৯৮৪ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল সাইন্স ফাউন্ডেশন সর্বসাধানণের জন্য ‘নেস্ফেনেট’ নামে একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করে। তিন বছরের মধ্যে এ ব্যবস্থা সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। সমগ্র ব্যবস্থাটি নিয়ন্ত্রনের জন্য ৯০ এর দশকে শুরুতে কেন্দ্রীয় নেটওয়ার্ক হিসেবে ইন্টারনেট গড়ে তোলা হয। ১৯৯৩ সালে বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য ইন্টারনেটকে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। অল্প দিনের মধ্যে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত হয লাখ লাখ সদস্য। পরবর্তীতে এ ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত সারাবিশে^ ছড়িয়ে পড়ে।

ইন্টারনেটের গুরুত্বঃ  আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের গুরুত্ব অপরিসীম। যোগাযোগের ক্ষেত্রে এটি যাগান্তকারী পরিবর্তন সাধন করেছে। ইন্টারনেট আবিষ্কারের পূর্বে পৃথিবীর কোনো জায়গায় খবর পাঠাতে বা সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করতে অনেক অর্থ, শ্রম ও সময় ব্যয় হতো। কিন্তু একন চোখের পলকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে তথ্য আদান-প্রদান করা যায়। শিক্ষা ও গবেষণার ক্ষেত্রে বই অত্যন্ত জরুরি, যা সবসময় হাতের কাছে পাওয়া যায় না। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে ঘরে বসে যে কোনো লইব্রেরির বই পড়ে তথ্য সংগ্রহ করা যায়। ইন্টারনেটের কল্যাণে চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়েছে আরও উন্নত, সহজলভ্য ও স্বল্প ব্যসম্পন্ন। কোনো রোগের চিকিৎসা দেশে না করানো গেলে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিদেমের ভালো ভালো ডাক্তাররের সাথে যোগাযোগ করা যায়। আবার আইনগত সহায়তার জন্য ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিখ্যাত আইনজীবীদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব। যারা ভ্রমণপ্রিয় তারা দেশে বসে যে কোনো দেশের আবহাওয়া জানা, হোটেল রিজার্ভ, প্লেনের টিকিট বুকিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারে। এর ফলে শ্রম, সময় ও অর্থ সাশ্রয় হয। তাছাড়া বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে সিনেমা দেখা, গান শোনা, খেলা দেখা, দৈনিক পত্রিকা পড়া, শেয়ার বাজর জানা ইত্যাদি ঘরে বসে সম্ভব হচ্ছে ইন্টারনেটের কল্যাণে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহারঃ  গোটা বিশ্ব যেখানে ইন্টারনেটের বদৌলতে দ্রুত সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, সেখানে সঙ্গত কারণেই বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকতে পারে না। বাংলাদেশে ইন্টারনেট চালু হয ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। তখন এর ব্যবহার ছিল সীমিত এবং কেবল ই-মেইলে তার প্রয়োগ ছিল। ১৯৯৬ সালের ১৬ জুন তেকে অনলাইন সংযোগ দেওয়া শুরু হলে বাংলাদেম তথ্য প্রযুক্তির বিশাল জগতে প্রবেশ করে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২টি প্রতিষ্ঠান অনলাইন সংযোগ দিয়ে থাকে। বাংলাদেশে প্রতিটি বিভাগীয় শহরে, প্রতিটি জেলায় ইন্টারনেট সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০০৫ সালের শেষ দিকে বাংলাদেশ প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ দ্বিতীয় সাবমেরিন কেবল নেটওয়ার্কের সাথে যুক্ত হয়েছে। এর ফলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা আরও উন্নত ও সুলভ হয়েছে।

ইন্টারনেটের নেতিবাচক দিকঃ  ইন্টানেটের বহুমাত্রিক উপকারিতার পাশাপাশি এর বেশ কিছু ক্ষতিকর দিকও রয়েছে। অবশ্য তা নির্ভর করে ইন্টারনেট ব্যবহার ও এর গ্রহণযোগ্যতার ওপর। ইন্টারনেটের সাহায্যে অনেক ধ্বংসাত্মক কাজ করা সম্ভব। ইদানিং ইন্টারনেটের মাধ্যমে মিথ্যা তথ্য সরবরাহ, পর্ন ছবি দেখা, জুয়া খেলা ইত্যাদির কালচার বাড়ছে। ফলে ছাত্রসহ যুবসমাজের মূল্যাবোধের অবক্ষয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশ ও জাতির জন্য মঙ্গলজনক নয়। কেউ কেউ ইন্টারনেটে ভাইরাস দিয়ে বহু কম্পিউটারের ক্ষতি করছে। যেমন- ১৯৮৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া বিশ^বিদ্যালয়ের কম্পিউটার নেটওর্য়াক ইচ্ছাকৃতভাবে কেউ ‘ইন্টারনেটে ওয়ার্ম’ নামক ভাইরাস ঢুকায়। ফলে বহু কম্পিউটার নষ্ট হয়ে যায়। অন্য একটি ঘটনায় যুক্ত রাষ্ট্রের তিনজন তেরো বছর বয়সী স্কুল ছাত্র তাদের স্কুলে বোমা রেখে ইন্টারনেটের মাধ্যমে পরে তার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয। দু-একটা নয়, এমন বহু উদাহরণ রয়েছে। প্রকৃত বিচারে ইন্টারনেটেনর কোনো অপকারিতা নেই। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর অসৎ উদ্দ্যেশ্যের মধ্যেই এর উপকারিতা নিহিত। ইন্টারনেটের তথাকথিত অপারিতার জন্য ইন্টারনেট দায়ী নয়. দায়ী এর ব্যবহারকারী।

উপসংহারঃ  বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানের বিস্ময়কর উপহার ইনটারনেট। ইন্টানেট বিশে^র এক প্রান্তের মানুষের মানুষের সাথে অন্য প্রান্তের মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থা অবনীয়রূপ সহজ করে দিয়ে গোটা বিশ্বকে একটি পরিবারে পরিণত করেছে। বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্ব এর ছোঁয়া লাগলেও মাত্রা খুবই করম। আগামী দিনে ইন্টারনেট ব্যবহার উন্নত বিশ্বের সাথে আমরা তাল মিলাতে পারব- আজকের দিনে এটিই আমদের প্রত্যাশা।

রচনাঃ চৈত্রের দুপুর
Previus
রচনাঃ শিশুশ্রম
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম