শ্রমের মর্যাদা- বাংলা রচনা/প্রবন্ধ


শ্রমের মর্যাদা

ভূমিকা: মানুষের সমস্ত সম্পদ এবং মানব সভ্যতার বুনিয়াদ রচনা করেছে যে শক্তি তার নাম শ্রম। ইংরেজিতে একটি কথা আছে "Industry is the key to success"  অর্থাৎ পরিশ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিশ্রম দ্বারা মানুষ সৌভঅগ্যের যে আনন্দ পাওয়া যায় , তার মতো আনন্দ আর কিছুতেই পাওয়া যাই না।

শ্রমের মর্যাাদা: শ্রম শব্দের আক্ষরিক অর্থ মেহনত বা দৈহিক খাটুনি। আর মর্যাদা শব্দের অর্থ মূল্যায়ন বা সম্মান প্রদর্শন । সুতরাং শ্রমের মর্যাদা বলতে বুঝায় মানুসের সকল প্রকার মেহনত বা খাটুনিকে যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং সম্মান দেখানো।

শ্রমের গুরুত্ব: মানজীবনের যে উৎকর্য সাধিত হয়েছে এবং মানব সভ্যতার যে বিকাশ ঘটেছে তাতে শ্রম দানের গুরুত্ব অপরিসীম। মানুষ শ্রম দেয় বলেই সভ্যতার চাকা ঘোরে।  Virgil "The dignity of labour makes a man self-confident and high ambitious. So the evaluation of labour is essential." সুতরাং জীবনের উন্নতির চাবিকাঠির পরিশ্রমের মধ্যে বিদ্যমান। শ্রমই ব্যাক্তিকে দিতে পারে ঐশ্বর্য। এজন্য ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে-. Industry is the mother of good luck. অর্থাৎ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি। মানব সভ্যতার প্রতিটি স্তরে আছে শ্রমের অবদান। সভ্যতার আদিপূর্বে মানুষ কায়িক আর মানবিক শ্রমের সহায়তার তীর ও নৌকা চলানো শিখেছে, তারপর সভ্যতার কৈশোরে চাষাবাদ শুরু করেছে, পরিশ্রমে গড়ে তুলেছে শস্য আর যৌবনে শিখেছে প্রসাদ নির্মাণ, নগর পত্তন। এভাবে শ্রম মানুষের জীবনে এনে দিয়েছে সমৃদ্ধি। শ্রম যে শুধু সকল সমৃদ্ধির উৎস তা নয়, শ্রম মানুষকে দেয় সৃষ্টির আনন্দ। প্ররিশ্রমের মধ্যে দিয়েই বিকশিত হয় মানুষের সৃষ্টিশীল প্রতিভা। পরিশ্রমের মধ্যমেই মানুষ নিজেই ভাগ্যকে গড়ে তোলে। পৃথিবীকে যা কিছু স্মরণীয় - বরনীয় তা পরিশ্রমের মাধ্যমেই অর্জিত হয়েছে। তাই শ্রমের গুরুত্ব উল্লেখ করে প্রখ্যাত লেখক ম্যাক্রিম গোর্কি বলেছেন, “শ্রম ও সৃজনের বীরত্বের চেয়ে গরীয়ান আর কিছু দুনিয়ার নেই।”

শ্রমের ক্ষেত্রে: যোগ্যতা অনুযায়ী প্রত্যেক মানুষেরই রয়েছে নিজস্ব কর্মক্ষেত্র। এ কর্মক্ষেত্রে জীবনের প্রয়োজনে মানুষের ব্যস্ত পদচারণা । পরিশ্রমের মাধ্যমেই এ কর্মক্ষেত্রে মানুষ সফলতা অর্জন করে। প্রবাদে আছে-  Man is the architect of his own fortune. অর্থাৎ মানুষ নিজেই ভাগ্য নির্মাতা। এ ভাগ্যকে নির্মাণ করতে হয় শ্রম দ্বারা, সৌভাগ্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণের একমাত্র উপায় শ্রম। কর্মমুখর মানব জীবনে নিরন্তর কোনো না কোন প্রতিকূলতার টিকে থেকেই অস্তিত্ব রক্ষা করতে হয়। তাই বলা যাই, জগৎ কর্মশালা আর জীবন মাত্রই পরিশ্রমের ক্ষেত্র।

আমাদের দেশে শ্রম সম্পর্কে ধারণা: আমাদের দেশে অনেকের ধারণা নিজে কাজ করলে আত্মসম্মানের হানি ঘটে। এ জন্য ছোট ছোট কায়িক শ্রমভিত্তিক কাজকে তারা মর্যাদাহীন মনে করে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোর দিক তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, কায়িক শ্রমের মাধ্যমে তারা উন্নতির স্বর্ণশিখরে আরোহণ করছে। তাই আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে শ্রমবিমুখতা উন্নতির অন্যতম প্রতিবন্ধক। কায়িক শ্রম মোটেই আত্মসম্মানের পরিপন্থী নয়; বরং তা সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান উপায়।

উন্নত দেশসমূহে শ্রমের মর্যাাদা: পৃথিবীর উন্নত দেশসমূহের প্রতি লক্ষ করলে দেখা যায় যে , শ্রমের প্রতি তারা বেশ মর্যাদাশীল । কোনো কাজকেই তারা মর্যাদা হানিকর মনে করে না। ছোট-বড় বলে সেখানে কোনো পার্থক্য নেই। শ্রমের প্রতি তারা বেশ আগ্রহ দেখিয়ে থাকে। একমাত্র শ্রমের বলেই আজ জাপান,জার্মান প্রভৃতি দেশ সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করেছে। পৃথিবীর যে জাতি যত বেশি পরিশ্রমী , সে জাতী তত বেশি উন্নত।

শ্রমের প্রকারভেদ:  জনৈক মনীষী বলেছেন. “অস্থায়ী জীবনটাকে যত বেশী পার কাজ লাগাইয়া লও।” শ্রমের মাধ্যমেই মানুষ তার জীবনকে সার্থক করতে পারে। শ্রম সাধারণত দুই প্রকার যথা। মানসিক শ্রম ও কায়িক শ্রম। মানসিক উন্নতি শ্রম ছাড়া হয় না। কথায় আছে- “অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা।” যে লোক শ্রমবিমুখ তার মনে কখনও সুচিন্তা ও সদ্ভাব উদয় হয় না; বরং কুচিন্তার আশ্রয়স্থল হয়ে পড়ে। পরিশ্রমী ব্যক্তির দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে যত গ্রন্থ রচিত হয়েছে তা সবই জগৎখ্যাত মনীষীদের মনীষীদের মানসিক শ্রমের ফসল। মানসিক শ্রম ব্যতীত এ সকল বিষয়ে জ্ঞান অর্জনও সম্ভব নয়। জগতের সকল জীবকেই বেঁচে থাকার তাগিদে কম-বেশি শারীরিক ও মানসিক শ্রম দিতে হয়। মানসিক শ্রম একটা কাজের উদয় করে আর শারীরিক শ্রমে তা সমাধা হয়। বিশ্বনিয়ন্তা আমাদের শারীরিক শ্রমের নিমিত্তে হাত-পা ইত্্যাদি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়েছেন। শারীরিক শ্রম আত্মসম্মনের পরিপন্থী নয়, বরং সমাজে প্রতিষ্ঠা লাভের প্রধান উপায়। চাষি, শ্রমিক, কুলি, মজুর, এরা দেশ ও জাতিকে রক্ষায় মহান দায়িত্ব নিয়েই শারীরিক শ্রমে অবতীর্ণ হয়। কবি নজরুলের ভাষায়-

“শ্রম বিনাঙ্কা-কঠিন যাদের নির্দয় মুঠিতলে ত্রাস্তা ধরনী নজরানা দেয় ডালি ভরে ফুলে ফলে।”

শ্রমশীল ব্যক্তির উদাহরণ:  পৃথিবীর বিখ্যাত ব্যাক্তি ও মনীষীগণের জীবনী আলোচনা করলে দেখা যায়, তারা সকলেই পরিশ্রমী ছিলেন। ওয়াশিংটন , আব্রাহাম লিংকন, বিজ্ঞানী আনস্টাইন, এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহম্মদ (সা.) কঠোর পরিশ্রমী ছিলেন। তিনি নিজ হাতে সকল কাজ সমাধ্য করতেন। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন সৈনিক। আবার মাটি কাটার কাজে সাধারণ শ্রমিকের মতো কাজ করে গেছেণ। তাতে তিনি লজ্জাবোধ করেননি। তিনি বলতেন, “নিজ হাতে নিজের কাজ করার মতো পবিত্র জিনিস আর নেই।”

উপসংহার: শ্রমশক্তি সমাজ-সভ্যতা নির্মাণ ও সাফল্যের চাবিকাঠি। একমাত্র শ্রমশক্তিই পারে মানুষকে সাফল্যের স্বর্ণশিখরে আরোহণ করাতে। এ শক্তিতে জাগরিত করার মাঝেই আমাদের মঙ্গল নিহিত । তাই আমাদেরকে শ্রম সম্পর্কিত সকল ভ্রান্ত ধারনা পরিহার করে এবং কোনো শ্রমকে মর্যাদা হানিকর মনে না করে পরিশ্রমী হতে হবে। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন শ্রমজীবি মানুষকে অলস বিজ্ঞজনের চেয়ে বেশি মর্যাদা দিয়ে বলেছেন,.... A hard working street cleaner is a better man than a lazy scholar.  সুতরাং জাতীয় ও ব্যক্তিগত জীবনে শ্রমের কোনো বিকল্প নেই।

শীতের সকাল অথবা, একটি শীতের সকাল-রচনা
Previus
অধ্যবসায়- বাংলা রচনা/প্রবন্ধ
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম