রচনা (প্রবন্ধ)“বইমেলা”


বইমেলা

ভূমিকাঃ  মানুষের ধুসর নিরানন্দ সমতল জীবনে প্রাণের প্রবাহ নামিয়ে আনে উৎসব। উৎসব আয়োজনের সে পথ ধরেই এদেশে মেলা তার বিস্তৃত পরিসর দখল করে আছে। মেলা এদেশের সাংস্কৃতিক জীবনের অন্যতম অঙ্গ। আর মেলার জগতে মিলনপিয়াসী সভ্যতার কনিষ্ঠ সন্তান ‘বইমেলা’। এখানে ঘটে সভ্যতার প্রাণের চিহ্ন বিভিন্ন বইয়ের সমাহার। যেখানে দেশি-বিদেশি বই-ই বাদ যায় না। তাই কবির কন্ঠে ধ্বনিত হয়-

“হেথায মিশেছে দিশি দিশি হতে, বিপুল জ্ঞানের ধারা, শত মনীষীর চিন্তার বাণী, আনন্দে আকুল পারা।”

বইমেলাঃ  ‘মেলা’ শব্দের ব্যাকরণগত উৎস ‘মিল’ ধাতু। মেলার অর্থ মিলিত হওয়া। ‘বইমেলা’ সেই মিলন প্রসংঙ্গের ইঙ্গিত বাহক। তাই বছরের কোনো এক সময়ে একটি নির্দিষ্ট উপলক্ষে কোনো স্থানে বইয়ের স্টল সাজিয়ে কিছু দিনের জন্য বই প্রদর্শন এবং বিক্রয়ের ব্যবস্থা করা হয়ে তাকে বইমেলা বা গ্রন্থমেলা বলা হয়। পৃথিবীর সকল দেশেই এমন গ্রন্থমেলার আয়োজন করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশেও প্রতিবছর বিভিন্ন উপলক্ষকে কেন্দ্র করে এমন বইমেলা বসে।

বইমেলার ইতিহাসঃ  বইমেলা বর্তমান আমাদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হলেও এর জন্ম হয়েছে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে। ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে স্টুরব্রিজের মেলা প্রথম অনুষ্ঠিক হয়। এ মেলার বইয়ের অংশের নাম ছিল ‘বুক সেলার্স রো’। ম্যাথু কেরীর উদ্যোগে ১৮০২ সালে সর্বপ্রথম যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে পূর্ণাঙ্গ বইমেলার আয়োজন করা হয়। বইয়ের একক উপস্থিতিতে ১৯২৪ সালে লিপজিগের বইমেলা আয়োজন হয়। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর বইমেলা পর্যায়ক্রমিক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ১৯৪৯ সালে ফ্রাঙ্কফুটে বইমেলার সূচনা হয়। এরপর ধীরে ধীরে বইমেলা সারা বিশে^ ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে জার্মানির লিপজিগ বা ফ্রাঙ্কফুর্ট ছাড়াও লন্ডন, সিঙ্গাপুর, কায়রো, প্যারিস, টোকিও , কলটাতা প্রভৃতি বইমেলাও স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সম্জ্জ্বুল।

বাংলাদেশে বাইমেলাঃ  বাংলাদেশের বইমেলার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শহিদদের স্মৃতিকে বাঙালি জাতির মানসে চির জাগরূপ রাখঅর প্রয়াসেই প্রথম বইমেলার আয়োজন করা হয়। বর্তমানে মেলাটিই ‘একুশে বইমেলা’ নামে বাংলা একাডেমির উদ্যোগে পুরো ফেব্রুয়ারি মাসব্যাপি অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় জীবনে ‘একুশে বইমেলা’র প্রভাব এতটাই ব্যাপক যে, এটি প্রতিনিয়তই সৃষ্টি করছে নতুন নতুন পাঠক ও বইপিপাসুর। ১৯৯৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে নিয়মিত আয়োজিত হচ্ছে ‘ঢাকা বইমেলা’। ১লা জানুয়ারি থেকে পনেরো দিনের এই মেলায় দেশের বিশিষ্ট প্রকামকরা অংশগ্রহণকরে। তা ছাড়া বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনও বার্ষিক বইমেলার আয়োজন করে। বাংলাদেশের বইমেলার আয়োজনে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জাতীয় পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন জেলা, থানা, পৌরসভাতে প্রকাশনা সংস্থাসমূহ বইমেলার আয়োজন করে ।

দেশের বইমেলা চিত্রঃ  বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা, লেখক-পাঠক-প্রকাশকদের মিলন মেলা। সারা দেশ থেকে আসা লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয়ে উঠে বইমেলা প্রাঙ্গণ। মেলার পরিচ্ছন্ন-সুন্দর, বর্ণোজ্জ্বল থরে থরে সাজানো থাকে নতুন পাতার গন্ধে মোড়ানো নতুন নতুন বই। এ বই গ্রন্থ প্রেমিকদের যে শুদু বিমোহিত করে তাই নয়, এখানে এসে লেখক-পাঠক-প্রকাশকগণ পরস্পর ভাব বিনিময়ের সুযোগ পায়। বইমেলার অংশ হিসেবে এখানে অনুষ্ঠিত হয় নতুন প্রকাশিত বইয়ের উপর আলোচনা, বিখ্যাত লেখকদের আলোচনা। তা ছাড়া লেখকের অসুবিধা, প্রকাশকের প্রকাশনা সংকট, পাঠকের বই কেনার, অনাগ্রহ প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা-সমালোচনা হওয়ার সাথে সাথে বইমেলা সম্পর্কে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা ও পরিকল্পনা নির্ধারণ করা হয়।

বইমেলা আনন্দমুখর পরিবেশঃ কর্মব্যস্ততার চাপে পড়ে আমাদের দেশে অভিভাবকগণ তাদের নিজেদের তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য পছন্দের বই, প্রিয় লেখকদের বই কিনতে পারেন না। কিন্তু বইমেলার আয়োজনে তারাও নেন সময়, ছেলেমেয়েদের নিয়ে চলে আসেন বইমেলায়। বই কেনার সাথে সাথে বেড়ানোর আনন্দটাও তারা উপভোগ করেন। বইমেলার ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ পুররো বন্ধু-বান্ধবের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া, জ্ঞানী-গুণীদের সান্নিধ্য লাভও কম আনন্দের নয়। আনন্দঘন ছোট ছোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বইমেলায় নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হয়। প্রতিদিনের আয়োজন সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাও বইমেলার পরিবেশকে আনন্দমুখর করে রাখে।

বইমেলার সমস্যাঃ  আমাদের দেশে প্রতিবছর সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ বেশকিছু বইমেলার আয়োজন করা হয়, যা অত্যন্ত প্রশংনীয়। কিন্তু বিশৃঙ্খলা ও অব্যবস্থাপনার কারণে বইমেলায় অনেক সময় অনেক সমস্যার সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশের বইমেলায় অনিয়ম সংঘটনের অন্যতম কারণ রাজনৈতিক মতাদর্শের পার্থক্য। এ ছাড়া বখাটেদের উৎপাত, মেলায় স্টল বরাদ্দ নিয়ে অনিয়ম, স্বল্প পরিসরে অধিক স্টল বরাদ্দ প্রভৃতি কারণে বইমেলা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়ে থাকে।

বইমেলায় বিদ্যমান সমস্যা সমাধানঃ  দেশের সকল শ্রেণির মানুষ যাতে বইমেলায় আসতে ও বই কিনতে আগ্রহী হয় তার জন্য বইমেলায় সমস্যা দূরীকরণে বেশিকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। যেমন- ১. বইয়ের কমিশন ২৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩৫-৪০ শতাংশ করা; ২. শৃঙ্খলা বজায় রাখতে দক্ষ কর্তৃপক্ষ নিয়োগ; ৩. দল-মত নির্বিশেষে সকালের সমান অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ; ৪. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন; ৫. স্টল বরাদ্দ নিয়ে অনিয়ম বন্ধ; ৬. স্থান প্রশস্তকরণ; ৭. বইমেলার বাইরে গড়ে ওঠা অন্যান্য সামগ্রীর জন্য নির্ধারিত স্থান নির্ধারণ।


বইমেলার গুরুত্বঃ ব্যক্তি, সমাজ তথা জাতীয় জীবনে বইমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। বইমেলায় লেখক, প্রকাশক ও ক্রেতাদের মধ্যে এক অপূর্ব মিলনের সুযোগ ঘটে। ফলে লেখক ও প্রকাশকের উপস্থিতি ক্রেতাদের বই কিনতে উৎসাহিত করে। তাছাড়া, বইমেলার রুচিকর পরিচ্ছন্ন পরিবেশ ক্রেতাকে বই কিনতে অনুপ্রাণিত করে। মেলা উপলক্ষে সদ্য প্রকাশিত বিভিন্ন বিষয়ের বিপুল সমাবেশ পাঠকদের বইয়ের প্রতি আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে তোলে। বিক্রেতারা অল্প লাভে বই বিক্রি করে নতুন পাঠক তৈরির আশায়। ফলে প্রকাশক আরো বই প্রকাশে উৎসাহিত হয়। বইমেলার বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও লেখকদের আলোচনা চক্র পাঠকের সাংস্কৃতিক রুচিকে উদ্দীপ্ত করে।

বইমেলার প্রভাবঃ বইমেলা মূলত আবাল বৃদ্ধ সকলের মিলন মেল। এর প্রভাবে মানুষে সৃষ্টি হয় প্রতিপূর্ণ বন্ধন। মুছে যায় সামাজিক ভেদরুদ্ধির ফলে সৃষ্ট ব্যবধান। বিখ্যাত লেখকদের বিক্রিত বইয়ে স্বাক্ষর দান, খ্যাতিমান কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি স্বাভাবিকভাবেই দর্শক- পাঠকদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। দর্শক-পাঠক আবিষ্কার করে তার নীরব সঙ্গী বইকে।

উপসংহারঃ বইমেলা মানুষের চিন্তার পরিমাপক। এর মাধ্যমে মানুষের রুচি ও আদর্শের উন্নতি ঘটে। তাই বইমেলার উন্নয়নে আমাদের আন্তরিক হতে হবে। কেননা বই মানুষকে দেয় জ্ঞান, জ্ঞান মানুষকে করে মহীয়ন। আর মহীয়ান মানুষই জাতিকে করে উন্নত। তাই শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসারে বইমেলার অবদানকে আমদের স্বাগত জানাতে হবে।

রচনা (প্রবন্ধ) “আমার দেখা একটি বইমেলা”
Previus
বাংলা রচনাঃ বেকার সমস্যা ও তার প্রতিকার
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম