বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা : সমস্যা ও সম্ভাবনা- রচনা


বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা : সমস্যা সম্ভাবনা

ভূমিকা : গণতন্ত্র তথা সংসদীয় রীতি-পদ্ধতির জন্য বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আন্দোলন দীর্ঘদিনের। ১৯৭১ সালে স্বাধান। ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর বাংলাদেশের জনগণ প্রত্যাশিত সংসদীয় গণতন্ত্রের পথেই প্রথম যাত্রা শুরু করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১০ জানুয়ারি চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংসদীয় গণতন্ত্রের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীকালে ১৯৭৭ সালে পঞ্চম সংশোধনার মাধ্যমে পুনরায় বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হলেও ১৯৮২ সালে সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে দেশে আবার গণতন্ত্রের যাত্রা রুদ্ধ হয়ে যায়। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে পঞ্চম জাতীয় সংসদে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

সংসদীয় সরকারব্যবস্থা : সংসদীয় সরকার পদ্ধতি মূলত একটি সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন পরিবেশ ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের রয়েছে বিভিন্ন মাত্রা। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীগণ মনে করেন ১. আইনসভার কাছে নির্বাহী কর্তৃত্বের জবাবদিহিতা, ২.স্বাধীন বিচার বিভাগ, ৩. নিয়মিত নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান, ৪. মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, ৫. জনস্বার্থে পরিচালিত প্রশাসন, ৬. আইনের শাসন প্রভৃতি সংসদীয় পদ্ধতির অনিবার্য শর্তাবলি।

Encyclopedia Britanica সংসদীয় সরকারের সার্থকতার জন্য ব্যক্তি স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর সুস্থ শুভবুদ্ধি, সর্বসাধারণের রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুবিধা, সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ এবং সমস্ত পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ব্যবস্থার পরিবর্তন সংসদীয় সরকারের প্রয়োজনীয় শর্তাবলি বলে উল্লেখ করেছেন। আর এসব শর্ত প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত। যথা : ১. সংবিধানের সর্বোচ্চ মর্যাদা ও সাংবিধানিকতা এবং ২. প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক দল ব্যবস্থা।

তবে বাংলাদেশের সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণের ক্ষেত্রে বহুবিধ সমস্যা রয়েছে।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার সমস্যা : বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার সম্ভাব্য সমস্যাগুলোকে প্রধানত দুভাগে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা : প্রথমত, আচরণগত বা সাংস্কৃতিক সমস্যা এবং দ্বিতীয়ত, আদর্শিক বা সাংবিধানিক সমস্যা। আচরণগত বা সাংস্কৃতিক সমস্যা : বাংলাদেশের গণতন্ত্র চর্চার আচরণগত বা সাংস্কৃতিক দিক বিশ্লেষণ করলে তিনটি গুরুতপর্ণ বিষয়। পাওয়া যায় : ১, রাজনৈতিক আচরণ, ২. রাজনৈতিক অনুশীলন ও ৩. রাজনৈতিক প্রথা বা পদ্ধতি, যা যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জানা একান্ত অপরিহার্য। আর তৃতীয় বিশ্বের একটি উন্নয়নশীল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের জন্য বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মৌলিক প্রশ্নে অনৈক্য, দশম সংসদে সরকার ও বিরোধী দলের টালবাহানা গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে আচরণগত সমস্যার সৃষ্টি করছে। এক্ষেত্রে অন্যান্য সমস্যাগুলো হলো :  লো

১. অসহিষ্ণুতা : গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে সহিষ্ণুতা, আপোশ এবং সমঝোতা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান কেবল তখনই কাজ করতে পারে, যখন রাজনৈতিক নেতারা আলাপ-আলোচনা এবং সমঝোতায় রাজি থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যুক্তিসঙ্গত সমঝোতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে, যা গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রধান সমস্যা।

২. নেতৃত্ব নির্বাচন : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও নেতৃত্ব নির্বাচিত হয় কে কতটা মারমুখী তা দিয়ে। বাংলাদেশের

প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছে এবং ক্ষমতায় ছিল কোনো দলেই স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব। নির্বাচন পদ্ধতি নেই। এই দলগুলোর নেতা-নেত্রী এমনকি কমিটি নির্বাচনের দায়িত্ব পর্যন্ত দলের প্রধান ব্যক্তির হাতে এবং সবকিছু। তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। ফলে গণতন্ত্র চর্চা সম্ভব হয় না।

৩. উপদলীয় কোন্দল : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতরে গণতন্ত্র চর্চার অনুপস্থিতির কারণে গোষ্ঠী ও উপদলীয় কোন্দল সৃষ্টি হয়, যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অসংখ্য উপদলের সমাহার লক্ষ্যণীয়। এ উপদলগুলো সময় ও অবস্থা বুঝে তাদের আনুগত্যের পরিবর্তন ঘটায়, যা গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়।

৪. রাজনৈতিক সহিংসতা : বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে উপদলীয় কোন্দলের কারণে রাজনৈতিক সহিংসতা স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সে কারণে রাজনৈতিক মতপার্থক্য মীমাংসার উপায় হিসেবে সহিংসতাকে ব্যবহার করা হয়। ফলে নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সন্ত্রাস বাংলাদেশের স্বাভাবিক ঘটনা।

৫. বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা : সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিরোধী দল একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এখন পর্যন্ত রাজনৈতিক বিরোধিতা সহ্য করার মতো ধৈর্য ও পরিপক্বতা অর্জন করতে পারেনি। জাতীয় স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যুতে বিরোধী দলসমূহের বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা গণতন্ত্র চর্চার অন্যতম অন্তরায়।

আদর্শিক বা সাংবিধানিক সমস্যা : প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশে কোনো রাজনৈতিক দলই এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠেনি। এক্ষেত্রে সমস্যাগুলো হলো :

১. সাংবিধানিক বাধা : বাংলাদেশ সংবিধানের ১১ নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র। এ সত্ত্বেও সংবিধানের মধ্যেই রয়েছে গণতন্ত্র বিকাশের পথে বিরাট বাধা। রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ তথা নির্বাহী বিভাগ, বিচার বিভাগ এবং আইন বিভাগ, যাদের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকতে হয়।

২. সাংবিধানিক অসামঞ্জস্য : বাংলাদেশের সকল ক্ষমতা প্রকৃত অর্থে এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত। ১৯৭৫-৯০ পর্যন্ত এই অপরিসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রাষ্ট্রপতি এবং ১৯৯০ সালের পর তা এসে জমা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ওপর। সংবিধান মোতাবেক রাষ্ট্রপতি কাজ করবেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে এবং এ নিয়ে আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না। এ সবই প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের সংবিধানের মর্মবস্তুই ক্ষেত্রবিশেষে গণতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যহীন।

গণতন্ত্র বিকাশে করণীয় : এ অবস্থায় বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে নিম্নোক্ত বিষয়সমূহকে গুরুত্ব দিতে হবে :

১. নিয়মিত অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন : গণতান্ত্রিক সমাজের প্রধান এবং প্রথম শর্ত হলো নিরপেক্ষ নির্বাচন। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে ক্ষমতাসীন হলেও নির্বাচন কমিশন সচিবালয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের অধীন। নির্বাচনকে নিয়মিত, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও প্রভাবমুক্ত করতে হবে।

২. বিচার বিভাগের স্বাধীনতা : ১/১১-এর পরে সামরিক বাহিনীর ছত্রছায়ায় আশ্রিত ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদান করলেও এখনও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন নয়। কেননা প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি।

৩. গণমাধ্যমগুলোর মুক্তপ্রবাহ অধিকার : গণতন্ত্রের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ ‘অবাধ ও মুক্তচিন্তা প্রবাহ', যা বাংলাদেশে এখনো

প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি। অবাধ তথ্যপ্রবাহের ব্যাপারে বাংলাদেশে দুই সরকারের ভূমিকা প্রায় একই রকম। প্রতিশ্রুতি দিয়েও আওয়ামী লীগ সরকার যেমন বেতার-টেলিভিশনের স্বায়ত্তশাসন দেয়নি, তেমনি জোট সরকার কমিশনের রিপোর্ট পাওয়া সত্ত্বেও কোনো কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেনি যা সম্পূর্ণ অযাচিত ও অনৈতিক।

৪. সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ : বাংলাদেশ সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক কোনো সাংসদ তার

সংসদীয় দলের সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট প্রদান করলে তার সদস্যপদ বাতিল হয়ে যায়। এ বিধানের পেছনে যে যুক্তি দেওয়া হয় তা হলো, টাকার লোভ দেখিয়ে সদস্যদের কিনে নিয়ে সরকারের পতন ঘটাতে পারে। অথচ আমাদের সংবিধানে আবার সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের সুযোগও রয়েছে। অর্থাৎ একদিকে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপনের সুযোগ এবং অন্যদিকে এ সম্পর্কে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ না দেয়া এক ধরনের পরস্পরবিরোধিতা।

৫. নারী সংসদ সদস্য নির্বাচনে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা : বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে নারীদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত আছে। সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের তিন দফার পরিবর্তে নতুন একটি দফা সংযোজন করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এই আইন প্রবর্তনকালে বিদ্যমান। সংসদের অব্যবহিত পরবর্তী সংসদের প্রথম বৈঠকের তারিখ থেকে শুরু করে ১০ বছর অতিবাহিত হওয়ার অব্যবহিত পরবর্তীকালে সংসদ ভেঙ্গে না যাওয়া পর্যন্ত মহিলাদের জন্য ৫০টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণে ২০১৮ সালে সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরো ২৫ বছর বৃদ্ধি করা হয়েছে। সংসদে রাজনৈতিক দলের নির্বাচিত সদস্যদের দ্বারা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে এসব আসনে নির্বাচন হবে। এ সংশোধনের পরও সরাসরি নির্বাচনে যে কোনো আসনে নারীরা অংশ নিতে পারবেন।

৬. দুনীতি ও সন্ত্রাসের মূলোৎপাটন : সর্বোপরি প্রশাসনের দুর্নীতি দূর করা, শিক্ষাঙ্গনকে সন্ত্রাস মুক্ত করা এবং সাম্প্রদায়িকতা পরিহার ত হবে। গণতন্ত্র হলো অনুশীলনের বিষয় এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তা বিকশিত হয়। আমাদের যা সমস্যা তা হলো নীলনের মানসিকতার অভাব। যে সরকার ক্ষমতায় থাকে তারা নিজেদের জোরেশোরে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকার বলে প্রমাণ করতে চায়, অতীতের কোনো সরকারই গণতান্ত্রিক ছিল না।

উপসংহার : সার্বিক বিবেচনায় বলা যায় যে, বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে যেমন অসংখ্য সমস্যা রয়েছে, তেমনি রয়েছে বিপুল সম্ভাবনা। তাই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের জন্য ক্ষমতাসীন দল ও ক্ষমতার বাইরের দলগুলোকে রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, আলোচনা, সমঝোতা, দলের ভেতরে ও বাইরে গণতন্ত্র চর্চা অব্যাহতভাবে অনুশীলন করতে হবে।

Epic - Literary Terms
Previus
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প : সমস্যা ও সমাধান-রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম