বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প : সমস্যা ও সমাধান-রচনা


বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প : সমস্যা সমাধান

ভূমিকা : তৈরি পোশাক শিল্প বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত। সম্ভাবনাময় এ খাতকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কর্মসংস্থানের বিশাল একটি বাজার। এ পোশাক শিল্পই হয়ে উঠেছে দেশের অর্থনীতির প্রধান চালিকা শক্তি। অথচ এ পোশাক শিল্পে দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা চলছে। কখনো শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতার দাবিতে বিক্ষোভ করছে, আবার কখনো কারখানায় হামলা করছে, আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে এবং মূল্যবান জিনিসপত্র ভাঙচুর করছে। এভাবে তৈরি পোশাক শিল্পে একটা বিশৃঙ্খলা লেগেই আছে। এ অস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা এদেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান এ খাতকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে এসব বিশৃঙ্খলা এবং অস্থিরতা চিরতরে বন্ধ করতে হবে। এর পাশাপাশি মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের সমস্যাসমূহ : বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে নানাধিক সমস্যা বিদ্যমান। নিম্নে বাংলাদেশের। পোশাকশিল্পের সমস্যাসমূহ আলোচনা করা হলো :

১. ভবন ধস : ভবন ধসে ব্যাপক সংখ্যক শ্রমিকের প্রাণহানি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বা গার্মেন্টস শিল্পের আলোচিত ও ভয়াবহ সমস্যাগুলোর অন্যতম। ২৪ এপ্রিল ২০১৩ ঢাকার সাভারে রানা প্লাজা' নামে নয়তলা একটি ভবন ধসে পড়ে। এ ভবনটিতে পাচটি গার্মেন্টস ছিল। এ ভবন ধসের ঘটনায় ১,১২৭ জনের প্রাণহানি ঘটে, জীবিত উদ্ধার করা হয় ২,৪৩৮ জন। এছাড়া ২০০৫ সালে স্পেকট্রাম গার্মেন্টস ভবন ধসে ৬৪ জনের প্রাণহানি ঘটে।

২. অগ্নিকাণ্ড : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প কারখানাগুলোতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রায়শই ঘটে। এতে করে মুহর্তেই অঙ্গারে পরিণত স্ব স্ব

ক্ষেত্রে লালন করা শ্রমিক-মালিকের স্বপ্ন। ১৯৯০ সালে সারকা গার্মেন্টসে ৩০ জন, ২০০৬ সালে কেটিএস গার্মেন্টসে ৫৫ জন, ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনস-এ ১১২ জন এবং ২০১৩ সালে তুং হাই সোয়েটার কারখানায় মালিকসহ ৮ জন আগুনে পুড়ে মারা যায়।

৩. দক্ষ শ্রমিকের অভাব : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের সাথে জড়িত শ্রমিকরা অধিকাংশই অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত ও অদক্ষ আমদানিকারকরা দেশের মানুষের রুচি ও নির্দেশ মোতাবেক পোশাক তৈরি করতে বলে। কিন্তু বাংলাদেশের অশিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত, অদক্ষ শ্রমিকরা অনেক সময় নির্দেশ অনুযায়ী চাহিদামতো পোশাক তৈরিতে ব্যর্থ হয়। তাই অনেক সময় বিদেশিরা তা গ্রহণ না করে ফেরৎ পাঠায় বা ভবিষ্যতে এদেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতি বিমুখ মনোভাব পোষণ করে।

৪. শ্রমিকদের নিম্ন মজুরি : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের দ্রুত বিকাশের মূলে রয়েছে শ্রমিক সহজলভ্যতা। শ্রমিক সহজলভ্যতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে পোশাক শিল্প মালিকরা শ্রমিকদেরকে তাদের ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। আট ঘণ্টার কাজ বারো বা যোলো ঘণ্টা করিয়েও ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত করছে, যা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য সবচেয়ে বড় সমস্যা বলে সম্প্রতি বিবেচিত হচ্ছে।

৫. বিশ্ববাজারে মূলহাস : গত কয়েক বছরে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাকের মূল্য উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। বিশেষ করে ওভেন পোশাকের কাটিং অ্যান্ড মেকিং (সিএম) চার্জ কমেছে ১৫ ভাগের বেশি। উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আগে প্রতি ডজন পোশাকে সিএম পাওয়া। যেত ১০ ডলার। বর্তমানে তা ৬ থেকে ৭ ডলারে নেমে এসেছে। নীট পোশাকের মূল্যও কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। চীন, ভিয়েতনাম এবং অন্যান্য প্রতিযোগী দেশ কম মূল্যে পোশাক সরবরাহ করার কারণে এক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা বেশ চাপে রয়েছেন।

৬. গ্যাস ও বিদ্যৎ সংকট : বিদ্যুৎ ও গ্যাসের তীব্র সংকটের কারণে পোশাক রপ্তানিকারকরা সমস্যায় পড়ছেন। পোশাক উৎপাদনকালীন এসব শিল্প প্রতিষ্ঠানে অধিকাংশ সময়ই বিদ্যুৎ থাকে না। গ্যাসের চাপ কম থাকায় উদ্যোক্তারা গ্যাস জেনারেটরও ব্যবহার করতে পারেন না। এক হিসাব মতে, পোশাক ও টেক্সটাইল খাতে বিনিয়োগ ২৬ শতাংশ কমেছে। কাজেই গ্যাস ও বিদাৎ সংকট বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে দিন দিন হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে।

৭. রপ্তানির সীমাবদ্ধতা : বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় ১১৫ প্রকারের পোশাকের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশসমূহের চাহিদা রয়েছে ৮৫ রকমের পোশাকের। অথচ বাংলাদেশ মাত্র ৩৬ রকমের পোশাক উৎপাদন করতে সক্ষম সফর। উৎপাদনের এ সীমাবদ্ধতা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অপর একটি বড় সমস্যা। অথচ হংকং ৬৫টি রকমের চীন ভারত ৬০ রকমের পোশাক রপ্তানি করে থাকে।

৮. মূলধনের স্বল্পতা : বিশ্বের উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশেরই শিল্পায়নের প্রধান অন্তরায়। মূলধন উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এ সমস্যার সম্মুখীন। বাংলাদেশের প্রভূত সম্ভাবনাময় পোশাক শিল্পে যে পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করা উচিত যথাসময়ে যথাযথভাবে সে পরিমাণে ব্যাংকসমূহ বা ব্যক্তিগত উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করতে পারছে না। ফলে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

৯. অনুন্নত অবকাঠামো ও অব্যবস্থাপনা : বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অপর একটি সমস্যা হলো অনুন্নত অবকাঠামো। বাংলাদেশের রাস্তাঘাট, কালভার্ট, হাসপাতাল প্রভৃতির অবস্থা যথেষ্ট নাজুক। তাছাড়া রয়েছে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের জন্য প্রয়োজনীয়। বরজনিত অব্যবস্থাপনা ও বন্দরের অভাব। এক হিসেবে দেখা যায়, বাংলাদেশের কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর ৮০ ভাগই অনৈতিক কাজে জড়িত। এরূপ অব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত দুর্বলতা বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করছে।

১০. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের বিকাশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি সবচেয়ে বড় বাধা হিসেবে কাজ করছে। চাদাবাজি, মাস্তানি, ছিনতাই, হরতাল, অবরোধ, বিক্ষোভ, ধর্মঘট, অপহরণ প্রভৃতি অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দিনের পর দিন একের পর এক ঘটেই চলেছে।

বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পে বিদ্যমান সমস্যা থেকে উত্তরণে আশু সুপারিশসমূহ : বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতিতে সবচেয়ে। সম্ভাবনাময় শিল্প হচ্ছে তৈরি পোশাক শিল্প। তাই এ শিল্পকে উত্তরোত্তর উন্নতি ও বিকশিত করতে হলে এর সমস্যার সমাধান অতি জরুরি। এ সম্পর্কে কতিপয় সুপারিশ নিম্নে উপস্থাপন করা হলো :

১. অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করা : অবকাঠামোগত উন্নয়ন তথা শিল্পাঞ্চলগুলোর সাথে বিশেষ করে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল, সড়ক, আকাশ পথে পরিবহন ব্যবস্থার আরো উন্নয়ন প্রয়োজন। অপরদিকে দ্রুততার সাথে গ্যাস, বিদ্যুৎ সংকট দূরীকরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

২. পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের প্রসার ঘটানো : বাংলাদেশে তৈরি পোশাক শিল্পের সুতা, বোতাম, কাপড় বিদেশ থেকে ৮৫ ভাগ আমদানি করতে হয়। কেননা দেশে প্রস্তুতকৃত কাপড়ের পরিমাণ খুবই অপ্রতুল। কাজেই পোশাক শিল্পের সমস্যা সমাধানে পশ্চাৎ সংযোগ শিল্পের প্রসার ঘটাতে হবে।

৩. পোশাক শিল্পকে আয়কর মুক্ত করা : পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে আয়কর মুক্ত করতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকার জন্য রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্পের আয় সম্পূর্ণভাবে করমুক্ত করে রপ্তানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করা প্রয়োজন।

৪. পোশাকের শ্রেণি বৃদ্ধি করা : বিশ্ববাজারে ১১৫ রকমের পোশাকের চাহিদা থাকলেও বাংলাদেশ মাত্র ৩৬ রকমের পোশাক তৈরি করতে পারঙ্গম। কাজেই বিশ্বের চাহিদা অনুযায়ী বাংলাদেশের পোশাকের শ্রেণি বৃদ্ধি করা একান্ত প্রয়োজন।

৫. শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি করা : বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাতে নিয়োজিত শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের দক্ষতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। প্রয়োজনে বিদেশে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রেরণের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৬. অ্যাপারেল বোর্ড গঠন করা : রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর বর্তমান বস্ত্র সেল পোশাক শিল্পখাতের বর্ধিত কর্মকাণ্ড তত্ত্বাবধান করার জন্য যথেষ্ট নয়। পোশাক সম্প্রসারণের সাথে সাথে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক একটি অ্যাপারেল বোর্ড প্রতিষ্ঠার জন্য দাবি জানিয়ে আসছে।

৭. বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ : বিদেশে প্রয়োজনে লবিস্ট নিয়োগ করা যেতে পারে। লবিস্ট নিয়োগ করলে তারা বিশ্বের বাজারে বাংলাদেশের। পোশাক শিল্পের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরতে পারবে ফলে এদেশে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পাশাপাশি পোশাক রপ্তানি বৃদ্ধি পাবে।

৮. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে হবে : দেশের সুস্থ ও স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি শিল্পোন্নয়নের পূর্বশর্ত। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলসমূহ কর্তৃক ঘোষিত হরতাল, অবরোধ, ধর্মঘট প্রভৃতির কারণে রপ্তানিমুখী শিল্পখাত, বিশেষ করে রপ্তানিমুখী | তৈরি পোশাক শিল্পখাত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। পোশাকশিল্প খাতকে সকল প্রকার রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতামুক্ত রাখার জন্য ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।

৯. আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন তথা প্রযুক্তিগত উন্নয়ন সাধন করা : পোশাক শিল্পকে বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে হলে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে মানসম্মত পোশাক তৈরি করা। আর এজন্য উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হবে।

১০. টেক্সটাইল পল্লি প্রতিষ্ঠা করা : সুতা, বস্ত্র, পোশাক ইত্যাদি উৎপাদনের ক্ষেত্রে কাঁচামাল যত কম নাড়াচাড়া করা যাবে, উৎপাদন ব্যয় তথা অপচয় তত কমবে। তাই টেক্সটাইল পল্লি প্রতিষ্ঠা করা একান্ত দরকার।

উপসংহার : পরিশেষে বলা যায় যে, দেশের রপ্তানি বাণিজ্যে তৈরি পোশাক শিল্পের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। এ শিল্প খাত থেকে রপ্তানি। আয়ের সিংহভাগই অর্জিত হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন, অধিক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বেকারত্বের চাপ রোধ এবং অধিক বৈষয়িক সমৃদ্ধি লাভের মাধ্যমে জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ঘটাতে তৈরি পোশাক শিল্পের অবদান অনস্বীকার্য।

বাংলাদেশে গণতন্ত্র চর্চা : সমস্যা ও সম্ভাবনা- রচনা
Previus
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প : সমস্যা ও সম্ভাবনা - রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম