বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা ও সমাধান - রচনা


জনসংখ্যা সমস্যা ও তার প্রতিকার।

ভূমিকা:  যে কোন দেশের জনসংখ্যা সে দেশের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু এ আর্শীবাদ অভিশাপে পরিণত হয় যখন এ জনসংখ্যা প্রয়োজনের তুলনায় কম বা বেশি হয়। জনগণ যখন তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয় তখনই তারা সমস্যায় পরিণত হয়। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা একটি অভিশাপ। বর্তমানে বাংলাদেশে অসংখ্য জটিল সমস্যার অন্যতম হচ্ছে জনসংখ্যা সমস্যা।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যার প্রকৃতি/স্বরূপ: বাংলাদেশে জনসংখ্যা সমস্যার প্রকৃতি হচ্ছে ‘অধিক জনসংখ্যা’ বা ‘জনসংখ্যাস্ফীতি’। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রাপ্ত এক সম্ভাব্য সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক বেশি। যখন কোন দেশের প্রাপ্ত সম্পদের তুলনায় জনসংখ্যা অধিক হয় এবং তার প্রভাবে সে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ব্যাহত হয় তখন তাকে জনসংখ্যাস্ফীতি বলা হয়। আর যখন জনসংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পেয়ে সামগ্রিক আর্থ-সামাজিক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় তখন তাকে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ বলা হয়। বাংলাদেশে অত্যধিক জনসংখ্যার কারণে সরকার এ সমস্যাকে ‘জনসংখ্যা বিস্ফোরণ’ নামে আখ্যায়িত করেছে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যা পরিস্থিতি: বাংলাদেশ বিশ্বের অষ্টম এবং এশিয়ার পঞ্চম জনবহুল দেশ। ২০০১ সালের আদমশুমারির তথ্যানুযায়ী জনসংখ্যা ছিল ১২ কোটি ৯২ লাখ এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির শতকরা হার ছিল ১.৪৭ ভাগ। জনসংখ্যার ঘনত্ব ১৯৯১ সালে ছিল প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ৭৫৫ জন। ২০০১ সালে তা শতকরা ২৪ ভাগ বৃদ্ধি পেয়ে ৮৩৪ জনে পৌছেছে। ২০০৩ সালে বাংলাদেশের প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ১৩.৩৪ কোটি এবং জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটার ৯১৬ জন।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ:  সাধারন ভাবে জনসংখ্যার হ্রাসবৃদ্ধিঘটে তিনটি কারনে। যথা-জন্ম, মৃত্যু ও দেশান্তর। জন্মহার মৃত্যু হারের তুলনায় বেশি হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। এছাড়া বরিরাগমনের ফলে অধিক সংখ্যক বিদেশি এসে বসবাস করা শুরু করলে জনসংখ্যা বাড়ে। বাংলাদেশে অধিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির বিভিন্ন করন রয়েছে। নিচে প্রধান কয়েকটি কারন উল্লেখ করা হল- ১। শিক্ষার অভাবঃ- আমাদের দেশে সাক্ষরতার হার অনেক কম। লোকজন শিক্ষিত হলে নিজের ভালোমন্দ সম্পর্কে সচেতন থাকে। পরিবার, সমাজ ও দেশের কল্যানের কথা ভাবে। ফলে পরিবার ছোট রাখে। কিন্তু শিক্ষার অভাবে আমাদের দেশের অধিক মানুষ এ বিষয়ে সচেতন নয়।

২। নারী শিক্ষার অভাবঃ- আমাদের দেশে নারী সাক্ষরতার হার অনেক কম। গ্রামে এ হার আরও কম। সাক্ষরতার নিম্ন হার দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির অন্যতম কারন।

৩। বাল্য বিবাহঃ- বাংলাদেশের মেয়েদের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছর। কিন্তু এ দেশে এখনও বাল্য বিবাহ প্রচলিত আছে। বিশেষ করে গ্রাম এলাকায় এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটে। ফলে জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে।

৪। অধিক শিশু মৃত্যুঃ- অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে শিশু মৃত্যু হার অনেক বেশি। শিশুদের মৃত্যু হার বেশি হলে মা বাবা ভাবষ্যতের কথা ভেবে অধিক সন্তান চান। এ ফলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

৫। পুত্র সন্তানের প্রত্যাশাঃ- আমাদের দেশের লোকেরা পুত্র সন্তান বেশি পছন্দ করে। ফলে পুত্র সন্তানের প্রত্যাশায় পরিবারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির অসুবিধা: জনসংখ্যা বৃদ্ধির অসুবিধা অনেক। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশের জীবনযাত্রার মান ও মাথাপিছু আয় অনেক কমে গেছে। আমাদের দেশে কৃষিযোগ্য জমির পরিমাণ সীমাবদ্ধ হওয়ায় গ্রামের কৃষকদের দুঃসহ অবস্থার মুখোমুখি দাঁড়াতে হয়েছে। খাদ্য সংকট দিন দিন দেখা দিচ্ছে। লোকজন চিকিৎসার সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেকার সমস্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। আবাসিক সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। ফলে শহরে বস্তি এলাকা গড়ে উঠেছে। পরিবেশের উপর বিরুপ প্রভাব পড়ছে। দিন দিন বায়ু দূষন, শব্দ দূষন এবং পানি দূষন প্রভৃতি বেড়েই চলছে। নানা রকম সামাজিক অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে শিক্ষা ব্যবস্থার ওপরও তীব্র আঘাত এসেছে। বিপুল সংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীর স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য জমি এবং শিক্ষা পরিচালনার জন্য অর্থ, এ দু’টিরই অভাব দেখা দিচ্ছে দিন দিন। অত্যাদিক জনসংখ্যার কারনেই বাংলাদেশের মানুষ আজ দুর্দশাগ্রস্থ এবং অভাব অনটনে জীবন কাটাচ্ছে।

বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধি সমস্যা সমাধানের উপায়ঃ  বাংলাদেশের জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের নিচের ব্যবস্থাসমূহ গ্রহণ করা যেতে পারে।

১. বাস্তব তথ্যনির্ভর জাতীয় জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন : বাংলাদেশে জনসংখ্যা অসমস্যার সমাধানের জন্য দরকার সুনির্দিষ্ট নীতি এবং বা¯তবসম্মত পরিকল্পনা গ্রহণ। এছাড়া জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানের জন্য প্রয়োজন জনসংখ্যা সমস্যা সংক্রাšত বিভিন্ন গবেষণা তথ্যের আলোকে জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, চিত্তবিনোধন প্রভৃতির প্রতি সমভাবে গুরুত্ব প্রদানপূর্বক বা¯তবায়নযোগ্য জনসংখ্যা নীতি প্রণয়ন।


২. পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সম্প্রসারণ:  দেশে আরো ব্যাপকভাবে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির তৎপরতা বৃদ্ধি করতে হবে। আরো অধিক সংখ্যক ক্লিনিক স্থাপন, মাঠকর্মী ও বিশেষজ্ঞ নিয়োগ এবং উন্নত যন্ত্রপাতি ও ওষুধপত্রের সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। তাহলে পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি জনগণের কাছে সহজসাধ্য হবে এবং তারা অধিক হারে এ পদ্ধতি গ্রহণ করতে পারবে।

৩. গণসচেতনতা বৃদ্ধিকরণ: জনসংখ্যার ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণ সচেতন না হলে এ সমস্যার সমাধান হবে না। তাই বিভিন্ন সামাজিক শিক্ষা কর্মসূচি, আলোচনা সভা, বেতার ও টেলিভিশন প্রোগ্রাম, নাটক, যাত্রা, থিয়েটার, জারিগান, কবিগান প্রভৃতির মাধ্যমে এ সমস্যার ভয়াবহতা সম্পর্কে জনগণকে সম্পূর্ণভাবে সচেতন করে তোলা উচিত।

৪. জনসংখ্যা শিক্ষা কার্যক্রম বাধ্যতামূলককরণ:  জনসংখ্যার বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বাল্যকাল থেকেই সচেতন করার জন্য জনসংখ্যা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা উচিত। এজন্য প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত পাঠ্যসূচিতে ‘জনসংখ্যা শিক্ষা’কে সম্পূর্ণ আলাদা এবং বাধ্যতামূলক পাঠ্য বিষয় হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা দরকার।

৫. নারী শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধিকরণ:  বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অবস্থার প্রেক্ষাপটে সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি ছাড়া জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়। সুতরাং নারীদের শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করলে তা জনসংখ্যাস্ফীতি হ্রাসে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করবে।

৬. বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ রোধ:  জনসংখ্যা সমস্যা প্রতিরোধ করতে হলে যে কোন মূল্যে বাল্যবিবাহ ও বহুবিবাহ প্রতিরোধ করতে হবে। প্রয়োজনবোধে এর বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৭. ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন:  ধর্মীয় সংস্কার প্রধান এবং বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে সহজ ও বোধগম্য ভাষায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ সংশিষ্ট বিষয়ে প্রকৃত তথ্যাদি প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। এর ফলে ধর্মভীরু জনগণ জন্মনিয়ন্ত্রণ সংশিষ্ট বিষয়ে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে প্রকৃত জ্ঞানার্জন করতে পারবে। >

জনসংখ্যা সমস্যা সমাধানে গৃহীত পরিকল্পনা ও কার্যক্রম:  বাংলাদেশে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পরিবার পরিকল্পনা ষাটের দশকের প্রথম দিকে সমাজকর্মী এবং পরিকল্পনাবিদদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তখন থেকে উন্নয়নের একটি কর্মকৌশল হিসেবে সরকার পরিবার পরিকল্পনাভিত্তিক কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে পরিবার পরিকল্পনা সেবা, তথ্য, শিক্ষা, উদ্বুদ্ধকরণ, প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো এবং দক্ষতা উন্নয়ন, দারিদ্র্য বিমোচন, গবেষণা, মূল্যায়ন, পরিবীক্ষণ প্রভৃতি।

উপসংহার: জনসংখ্যা বৃদ্ধিজনিত সমস্যা নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের এক নম্বর জাতীয় সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে এটি শুধু সংখ্যার প্রশ্ন নয়, এটি যেমন আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতির প্রশ্ন, তেমনি দর্শন, নীতিবোধ, ধর্ম, মনস্তত্ত্ব, জৈবিক চাহিদা ইত্যাদির বহু প্রশ্নের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। সুতরাং সামগ্রিক দৃষ্টিকোণ থেকে জনসংখ্যা সমস্যাটি বিশ্লেষণ করে তার সমাধানের বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

বর্ষাকাল- রচনা/প্রবন্ধ
Previus
সংবাদ পত্র - রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম