বই পড়ার আনন্দ-রচনা


বই পড়ার আনন্দ

ভূমিকাঃ বই মানুষর পরম বিশ্বস্ত বন্ধু। সামাজিক জীব হিসেবে মনুষ অন্যের সাহচর্য পাওয়ার পাশাপাশি বইকেও বন্ধু হিসেবে বেছে নিয়েছে। বইয়ের সাথে গড়ে তুলেছে আত্মিক সম্পর্ক। মানবজীবন প্রবাহের যাবতীয় ভাব-অনুভূতি জানার প্রবল আগ্রহ মানুষকে বইমুখী করেছে। মানুষের হাসি-কান্না , আনন্দ-বেদনার অনুভূতি ধারণ করে বই অতীত বর্তমান ও অনাগত ভবিষ্যতের মদ্যে যোগসূত্র স্থাপন করে। তাই বই পড়ে মানব মন লাভ করে পরম প্রশান্তি।

বইয়ের আবির্ভাবঃ সভ্যতা বিকাশের এক পর্যায়ে মানুষ তার হৃদয়ের ভাবকে, অভিজ্ঞতারলব্ধ জ্ঞানকে অন্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার আকাংখা যখন প্রকাশ করল, তখন তারা আশ্রয় নিল বইয়ের। নিজেদের ভাব অনুভূতি লিখে অন্যদের জানানোর চেষ্টা করে তারা। সেক্ষেত্রে মুদ্যণ যন্ত্র আর ছাপাখানার আবিষ্কার বইয়ের প্রচারকে করেছে বিস্তৃত। আর এভাবেই অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জনের উন্মুক্ত হয়। বই পাঠের প্রয়োজনীয়তাঃ বিশ্ববিখ্যাত ঔপন্যাসিক লিও টলস্টায় মানবজীবনে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে গিয়ে বলেন, “ Three things ate essential for life and those are books , books and books” তাঁর এ উক্তিটি থেকে বইয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুধারণ করা যায়। বই মানুষকে একই সাথে আনন্দ ও জ্ঞান দান করে। জ্ঞানী গুণী ব্যক্তিদের জ্ঞানভান্ডার আজ মহাসমুদ্র হয়ে স্বল্পায়ু মানুষের জ্ঞান-পিপাসা মিটানোর অপেক্ষায় বইয়ের রূপ ধারণ করে আছে। যুগে যুগে পৃথিবীকে মহামানবের আবির্ভাব ঘটেছে। তারা মানুষকে শুনিয়েছেন আত্মার মুক্তির গান। হোমার, ভার্জিল, শেক্সপিয়র, দান্তে, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, এরিস্টটল, প্লেটো, জীবনানন্দ দাশ, প্রমথ চৌধুরীর মতো মহামানবেরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। কিন্তু তারা রেখে গেছেন তাঁদের মহামূল্যবান বই। এসব বই পড়ে তাঁদের সান্নিধ্য পাওয়া যাবে, উপলব্ধি করা যাবে তাদের উপস্থিতি, জানা যাবে তাঁদের মূল্যবান জীবন র্দশন। তাই মানুষের জ্ঞানভান্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্য এবং আনন্দের অফুরন্ত উৎসের জন্যে বই পাঠের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

মানুষের মন ও বইঃ বই পাঠে মানুষের কোমল মনে জন্ম দেয় আনন্দ , বেদনা, বিস্ময়, নীতি, সহানুভূতি, স্নেহ, প্রেম, মায়া মমতা, ভক্তি প্রভৃতি সুকুমার বৃত্তি। বই পাঠে মানুষের মনে এক অপূর্ব শিহরণ জাগে। বই পাঠ করেই সে এ পৃথিবীর বিশালত্ব অনুভব করতে পারে। বই পাঠের মাধ্যমে মানুষ সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের সন্ধান পায় । কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন-

“বিশাল বিশ্বরে আয়োজনে মন মোর জুড়ে থাকে অতি ক্ষুদ্রতারই এক কোণে সেই ক্ষোভে পড়ি গ্রন্থ ভ্রমণ বৃত্তান্ত আছে যাহে অক্ষয় উৎসাহে”

বই পড়ে মানুষের মনে নতুন প্রেরণা ও উৎসাহ জন্মে। সুখ-দুঃখ আনন্দ বেদনা সব মুহুর্তেই বই মানুষের পাশে থাকে। বই কখনো পূরনো হয় না। বাংলা সাহিত্যের রবীন্দ্রনাথ , নজরুল, জীবনানন্দ প্রভৃতি সাহিত্যিকদের বই এখনো পাঠকের মনে আনন্দের জোয়ার বয়ে আনে। আর এ কারণেই বই মানুষের মনে চিরকালের জন্য স্থান করে নিয়েছে।

আনন্দের উৎস বইঃ মানুসের আনন্দ লাভের পথ বিচিত্র। বই পাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ। বই মানুষের হৃদয়ে আনন্দের অফুরন্ত উৎস। বই বিচিত্র বিষয় নিয়ে রচিত, যা মানুষের মনকে আনন্দ দান করে। স্বল্পায়ু মানুষ তার মন ও হৃদয়কে সুখ ও আনন্দে দান করে ঐশ্বযময় করে তুলে। বই আনন্দের পাশাপাশি মানুষকে জ্ঞান দান করে অদিকতর যোগ্য করে গড়ে তোলে। বই জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণের সুযোগ দান করে। তাছাড়া বই সভ্যতার বাহক হিসেবে কাজ করে। বই পাঠ করে আমরা বিভিন্ন সভ্যতা সম্পর্কে জানতে পারি। ফলে আমাদের দুষ্টিভঙ্গির পরির্বতন হয়। তাই যে জাতি বইবিমুখ, তারা আনন্দের অফুরন্ত উৎস থেকে বিঞ্চত হয়ে সংকীর্ণতা ও কৃপমন্ডূকতার শিকার হয়।

বইয়ের বৈচিত্র্যঃ সভ্য মানষের প্রয়োজন অসংখ্য গ্রন্থরাজির সান্নিধ্য ও সঙ্গ। বিচিত্রে বইয়ের বাহারি বৈচিত্র্য থেকে মানুষ আনন্দের বিযার্রস পান করে। ইতিহাস , দর্শন, বিজ্ঞান, সাহিত্য ইত্যদিা বইয়ের পাতায় পাতায় মিশে আছে বিভিন্ন জাতির জ্ঞান, বিজ্ঞানও শিল্প সাহিত্যের স্রােথধারা। সে ধারার মোহনায় সঙ্গম ঘটাতে পারলেই মানুষের আত্মপ্রসার ঘটে এবং গড়ে উঠে অসাধারণ ব্যক্তিত্ব।

সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বইঃ অতীত – বর্তমান ও ভবিষ্যতের মধ্যে সেতু রচনা করে যুগোত্তীর্ণ গ্রন্থরাজি। গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয়ে চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম অগ্রযাত্রার পথে। আমাদের বৃহত্তর জীবনের যাত্রাপথ্রে সবচেয়ে বড় সঙ্গী বরেণ্য মনীষীদের লেকা মূল্যবান বই । একবিংশ শতাব্দীর এ বিশ্বে হোমার , দা›েত, এডিসন, মাদাম কুরি, প্লেটো, এরিস্টটল এদের প্রত্যক্ষ সান্নিধ্য পাওয়া সম্ভব না হলেও যদি গ্রন্থাগারে তাদের বই থাকে, তাহলে পাওয়অ যাবে তাদের নিকট সান্নিধ্য। বইয়ের মাধ্যমেই আমরা তাঁদের কর্মউদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার অনুপ্রেরণা পাব।

মানবজীবনের উৎকর্ষ সাধনে বইঃ মানবজীবন কঠিন সাধনার ক্ষেত্র। এখানে যথার্থ মানুষ হতে হলে প্রাণপণ চেষ্টা চালাতে হয় । আর এর জন্য প্রয়োজন জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো। বই জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে মানুষকে সঠিক পথ প্রদর্শন করতে পারে । বইয়ের সান্নিধ্যে মানুষ বিভিন্ন জ্ঞানী -গুণীদের মননের সাথে পরিচিত লাভ করে। তাদের চিন্তা- চেতনার সংসর্গ লাভ করে। আর এই শিক্ষা কাজে লাগিয়ে জীবনে উৎকর্ষ লাভ করা সম্ভব। কুসংস্কার, জড়তা আর মিথ্যাকে বিদূরিত করে মনের শুদ্ধতা আনয়ন করা যায় জীবন ঘনিষ্ঠ ভালো বই পাঠ করে। এতে যেমন পরম আনন্দ ও প্রশান্তি লাভ করা যায় , তেমনি জীবনকে সার্থকতা ও সফলতার সীমার পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়।

সত্যের সন্ধান দেয় বইঃ বই শুধু জ্ঞানর্জনের উপায়ই নয়, বই সত্য, সুন্দর , আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠক- পাঠিকাকে আলোড়িত করে। জ্ঞানী ব্যক্তিরা বই পাঠের মাধ্যমে সত্যকে উপলব্ধি করে। কবিগুরু বলেছেন-

“সেই সত্য যা রচিবে তুমি ঘটে যা তা সত্য নয়।”

এধরণের অজস্র কথার মধ্যে সত্যদ্রষ্টা সত্যকে খুঁজে পাবার সাধনায় মগ্ন থাকে। আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয গ্রন্থ যেমন, কোরআর, বেদ, পুরাণ, মহাভারত, গীতা, বাইবেল, ত্রিপিটক, ইত্যাদি জ্ঞানসমৃদ্ধ গ্রন্থসমূহ মানুষকে সত্য পথের সন্ধান দেয়।

বই নির্বাচনঃ বই জ্ঞানের বাহক হলেও বই নির্বাচনের ব্যাপারে খুবই সতর্ক থাকতে হবে। কেননা বাজারে আজ অশ্লীর ও নিম্ন মানের বইয়ের ছড়াছড়ি। এসব বই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের চরিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। তাছাড়া বই পড়ার প্রকৃত আনন্দ কেবল ভালো বই থেকেই পাওয়া সম্ভব, খারাপ ও অশ্লীল বই থেকে নয়। তাই চরিত্র গঠন ও জ্ঞান অন্বেষণের মহান স্বার্থে সকলেরই উচিত ভালো বই নির্বাচন করা।

উপসংহারঃ বই পাঠে মানুষ আনন্দ লাভ করে থাকে সত্য, তবে আনন্দ উপলব্ধির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। বইয়ের জগৎ থেকে আনন্দ লাভের জন্য মানুষকে অধ্যবসায়ী হতে হবে। উৎকৃষ্ট বই মানুষকে প্রকৃত ও আনন্দ দান করতে পারে । তাই ভালোবাসতে হবে বইকে, বইয়ের সাথে গড়ে তুলতে হবে সখ্য।

রচনা(প্রবন্ধ)“দেশ গঠনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা”
Previus
জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা-রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম