বাংলা রচনাঃ যৌতুক প্রথা


যৌতুক প্রথা

ভূমিকাঃ যৌতুক একটি ভয়াবহ সামাজিক সমস্যা। প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী এল কে ফ্রাংক এর মতে, সামাজিক সমস্যা বলতে এমন একটি সামাজিক অসুবিধা কিংবা অসংখ্যা লোকের অসদাচারণকে বোজায় তাকে শোধরানো বা দূর করা দরকার। এ সংজ্ঞার নিরিখে বাস্তব প্রেক্ষাপট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, যৌতুক প্রথা আমাদের সমাজের বন্ধে রন্ধ্রে এমন ভাবে জেঁকে বসেছে যে,বর্তমানে পরিবার একটি কল্যাণ মূলক প্রতিষ্ঠার থেকে পরিবর্তিত হয়ে নির্যাতন ও মনোযাতনা সৃষ্টির কারখানায় পরিণত হয়েছে। অচিরেই এ ভয়াবহ প্রথার বিরুদ্ধে কার্যকারী পদক্ষেপ গ্রহন করতে না পারলে কল্যাণ মূলক সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিবারের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে।

যৌতুকঃ বাংলায় যৌতুকের সমার্থক শব্দ হচ্ছে ‘পণ’ হিন্দি এবং উর্দুতে’দাহেজ’ ‘মহন’বা ‘মহরানা’ এবং ইংরেজীতে ‘‘Dower’’থেকে Dowry’। তবে সমার্থক হলে ও শব্দ গুলোর মধ্যে ব্যবহারিক দিক দিয়ে বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে সাধারণভাবে মেয়েপক্ষ কর্তৃক ছেলেপক্ষকে এসব দেয়া হলে তাবে বলা হয় পণ। অপরদিকে মুসলিম পারিবারিক আইন বা শরীয়াহ আইন অনুসারে বিয়ের সময় স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে বাধ্যতামূলক ভাবে প্রদেয় অর্থ,সম্পদ হচ্ছে ‘মহর’ বা ‘মহরানা ’। বিশেষজ্ঞদের মতে,এটি কোনোভাবেই যৌতুক নয়। ১৯৬১ সালের ভারতীয় যৌতুকের অন্তভূক্ত করা হয় নি। প্রকৃতপক্ষে বিয়ের সময় বর বা অনেকক্ষ বিয়ের সময় বর বা কনেপক্ষে থেকে নগদ অর্থ , উপঢৌকন বা সম্পওি আদায় করা হয় বা আদায়ের অঙ্গীকার করানো হয়, তো- ই যৌতুক ।

যৌতুকের উৎপওিঃ প্রাচীন ভারতীয় হিন্দু সমাজে বরপক্ষ কর্তৃক কনেপক্ষকে যৌতুক দেয়ার মাধ্যমে পণপ্রথা হিসেবে যৌতক প্রথার প্রচলন হয়। কিন্তু আধুনিক কালে হিন্দ সমাজে বিশেষশত উচ্চ বংশের লোকদের মধ্যে অভিজাততন্ত্র বা বর্নপ্রথার কারণে বরপক্ষকে যৌতুক দেয়ার প্রথা দেয়ার প্রথা প্রচলিত হয়। অপরদিকে হিন্দু পারিবারিক আইনের কারণে ও হিন্দু সমাজের যৌতুকের ব্যাপক প্রসার ঘটে। এ কই ভাবে সেই প্রাচীন কাল থেকেই মুসলিম সমাজে ও প্রণপ্রথা ও যৌতুক প্রথার প্রচলন রয়েছে। তবে বর্তমানে পাক ভারত উপমহাদেশের বিভিন্ন সমাজে ব্যবস্থার কেবল যৌতুকের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। যৌতুকের কারণঃ প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পযর্ন্ত যৌতুকের প্রথার প্রচলন ও বহাল তবিয়তে টিকে থাকার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। কয়েকটি দিক পর্যালোচনা করলে বিষয়টি আর ও স্পষ্ট হবে-

ক. অর্থলোলুপতাঃ অনেক যুবকের মধ্যেই নিজের অযোগ্য শ্রমবিখুমতা সংশোধনের প্রবণতা নেই। অন্যের কষ্টর্জিত ভান্ডার থেকে যথেষ্ঠ লুন্ঠন করে নিজের শূণ্যতম মানসিকতা তাদেরকে ভীষণ ভাবে তাড়িত করে। একই মনোভাব পোষণ করেন তাদের অভিভাবকগণ ও। তাদের এ অর্থলোলুপতা যৌতুক প্রথাকে ভয়াবহ রুপদান করেছে।

খ. কৌলিন্য প্রথাঃ প্রাচীনকালে থেকে স্বচ্ছল কন্যাপক্ষ বরপক্ষকে নানা প্রকার উপহার সামগ্রী প্রদান করত। এসব উপহার সামগ্রী ছিল তাদের কৌলিন্য তথা আভিজাত্যের প্রতীক । কিন্তু কালক্রমে এ রীতি বাধ্যবাধকতায় রূপান্তরিত হয়ে ভয়াবহ যৌতুক প্রথার রুপ ধারন করেছে। অপরদিকে নীচ বংশের কনেকে উচ্চ বংশের বরের সাথে বিয়ে ক্ষেত্রে কনের যোগ্যতার ঘাটতি পূরণে যৌতুক প্রদানের গুরুত্ব লাভ করে।ফলে বংশীসূত্রে যোগ্য পাত্রে কন্যা সম্প্রদানের ক্ষেত্রে কন্যাপক্ষ যৌতুক প্রদানে বাধ্য হয়।

গ. হিন্দু পারিবারিক আইনঃ হিন্দু পারিবারিক আইন অনুসারে মেয়েরা উওরাধিকারসূত্রে পিতৃসম্পদের দাবিদার নয়।ফলে ‘যা নেওয়ার তা বিয়েই সময়ই নিয়ে নাও’- এ ধরনের মানসিকতা সৃষ্টি হয়, যথা যৌতুক প্রথাকে আর ও তীব্র করে।

ঘ. অনগ্রসর নারী শিক্ষাঃ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এমনকি এখন ও অনেক অভিভঅবক মনে করেন যে, মেয়েদেরকে শিক্ষিত করে তোলার পেছনেঅর্থব্যয়ের কোনো যৌক্তিকতা নেই। ফলে আমাদের নারীসমাজ শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চাৎপদ। তাদের এ পশ্চাৎপদতা যোগ্যতার নিরিখে তাদেরকে পেছনে ফেলে দিচ্ছে। তাই যোগ্য শিক্ষিত পাত্র যোগাড় করার জন্য কন্যাপক্ষ যৌতুক দিতে হচ্ছে। বস্তুত কন্যাপক্ষের নিকট বরের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও ভালো চাকরি পাবার সম্ভাবনার কারণে তার মূল্য অনেক বাড়িয়ে দেয়।

ঙ. নারীর অবমূল্যায়নঃ পুরুষতান্ত্রিক এসমাজে নারীকে বস্তুর সাদৃশ্যে বিচার করা হয়। সমাজে নারীর এ অবমূল্যায়ন যৌতুক প্রথার উৎপওির ভাষার –‘‘নারীর সম্মান আসম্মানের মূল্য নির্ভর করে পুুেষের ধারণার উপর। নারীকে ইচ্ছা ও অনুভূতির মানবিক স্বাতন্ত্র্যে মূল্যায়িত না করে জড়বস্তুর মতো ভাবা হয়।’’ আর নারীর এ অবমূল্যায়নের জন্য যৌতুকের অর্থ সমন্বয় করে নারীর স্থান নির্ধারন করা হয়।

যৌতুকের প্রভাবঃ আমাদের আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটে যৌতুক ভয়াবহ প্রভাব বিস্তার করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে যৌতুকের দাবির মেটাতে গিয়ে অনেক পরিবারের আর্থিক সংকটের মুখোমুখির হতে হয়। কারণ যৌতুকের দাবি মেটানোর জন্য তাদেরকে জমি, গৃহস্থালির বিভিন্ন দ্রব্যাদি এবং কখনো কখনো বসতভিটা ও বিক্রি করে দিতে হয়। কারণ যৌতুকের দাবি মেটানোর জন্য তাদের জমি, গৃহস্থলির বিভিন্ন দ্রব্যাদি এবং কখনো কখনো বসতভিটা ও বিক্রি করে দিতে হয়। এরপর ও কনের পিতামাতার মনের মেয়ের ভবিষ্যৎতে সম্পর্কে কোনো নিশ্চয়তা থাকে না। কারন কখনো বিয়ের সময় নির্দিষ্ট করা যৌতুকের দাবি পুরোপরি পূরণ করার পর নতুন করে যৌতুক দাবি করা হয়। প্রকৃতপক্ষে যৌতুক নারীর প্রতি অন্যায়, অসাম্য ও শোষণ নির্যাতনকেই প্ররোচিত করে। ফলে পারিবারিক জীবন অনিরাপদ ও দাম্পত্য জীবন জটিল হয়ে পড়ে। চুক্তি অনুসারে কিংবা দাবিকৃত যৌতুক যথাসময়ে যথাযতভাবে দেওয়া না হলে কনের ওপর নেমে আসে অকথ্য নির্যাতন, যা কখনো কখনো তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। বস্তুত যৌতুকের সর্বনাশা রীরিতে মানুষের মর্যাদা হারিয়ে একটি মেয়ে হয়ে পড়ে ক্রয় বিক্রয়ের বস্তু আর মেয়ের অসহায় অক্ষম পিতা হয় একজন নতজানু ব্যক্তিমাত্র। অন্যদিকে কন্যাদায়গ্রস্ত অভিভাবগণ কোনো না কোনোভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে চান। ফলে অনেক সময় সমাজে বহুবিবাহ দেখা দেয়।ঊনবিংশ শতাব্দীতে এ অবস্থা এত তীব্র আকার ধারণ করেছিলেন যে, হিন্দু সমাজে উচ্চবর্ণের কোনো ব্রাহ্মণের শতাধিক বিয়ের প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা স্ত্রীদের শ^শুর বাড়িতে ফেলে রাখতেন এবং সারাবছর এক শ্বশুর বাড়ি থেকে অন্য শ্বশুর বাড়িতে পালাক্রমে থাকতেন এবং পরজীবীর মতো জীবিকা নির্বাহ করতেন। বর্র্তমান কালে ও যৌতুকের দাবি মেটাতে না পারায় অনেক বিয়ে ভেঙ্গে যায় এবং যৌতুকের আশায় অর্থলোভী পুরুষ পুনঃপুন বিয়ে করে । মোট কথা বর্তমানে সমাজে সবচেয়ে অমানাবিক ও ও ঘৃণা প্রথা হলো এ যৌতুক প্রথা, যা তার ও জন্যই কল্যাণই নয়।

বাংলাদেশের যৌতুক বিরোধী কার্যক্রমঃ ১৯৪৫ সালের ‘কুলীনকুল সর্বস্ব’ নাটকটিকে এতদঞ্চলে প্রথম যৌতুকে বিরোধী পদক্ষেপ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। নাটকটি যৌতুক বিষয়ে সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল। এরপর যৌতুকের বিরুদ্ধে তাদের বলিষ্ঠ লেখনি তুলে ধরেছিলেন। নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখায়াত হোসেন ১৯০৪ সালে শ্বশুরের কাছ থেকে যৌতুক দাবিদারদের কঠোর সমালোচনা করেন। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রতিনিধিবৃন্দ দীর্ঘকাল যাবৎ যৌতুক বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন। বাংলাদেশের সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছেন। এছাড়া ১৯৮৩, ১৯৯৫,ও ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের আইন প্রণয়নের করা হয় যেগুলো যৌতুকের কারণে স্ত্রী হত্যা বা মারাত্মক ভাবে আহত করার শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও অর্থদন্ডের বিধান রাখা হয়। তবু ও যৌতুকের সম্পূরূপে দূরীভূত হয় নি বরং দিন দিন তা বিস্তৃত হয়ে ভয়াবহ রুপ ধারণ করছে।

যৌতুকের নিবারণের উপায়ঃ যৌতুত একটি ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধি হওয়ার এবং সমাজের অনেক গভীরে এর শিকড় প্রোথিত থাকায় সমাজ থেকে এটি সম্পূর্ণ দূরীভূত করা একটি সময় সাপেক্ষ ও জটিল কাজ। তাই যৌতুক নিমূর্লে নিচের সুপারিশগুলো গ্রহন করা যেতে পারে:- ক. ধর্মীয় অপব্যাখ্যা ও সামাজিক বিধিনিষেধ এখন ও নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায় । তাই জনসচেতনতা সৃষ্টি করে নারীশিক্ষা নিশ্চিতকরণের মাধ্যমে নারীকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে হবে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি আয় বৃদ্ধিকারী কার্যক্রমে কার্যকরভাবে উৎসাহিত করতে হবে। খ. জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপওা ব্যবস্থার উন্নয়নে যথাযথ কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে।


গ. যৌতুক নিরোধ আইনের যথাযথ ও কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। ঘ. বিভিন্ন নারী সংগঠন প্রগতিশীল শক্তিসমূহ ও সচেতন জনগণকে সমাজ থেকে যৌতুক নিমূর্লে সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে আসতে হবে। বিশেষত যৌতুকের শিকার নারীদেরকে নিশ্চুপ না থেকে সোচ্চারকন্ঠে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে হবে। ঙ. স্বচ্ছল ও অভিজাত লোকদের মধ্যে বরপক্ষকে অধিকতর মূলবান উপঢৌকন প্রদানের অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে হবে। বিয়ের ব্যয় সংকোচন ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। চ. যেহেতু যৌতুক প্রথার প্রধান ধারক ও বাহক হচ্ছে পুরুষ, সেহেতু তাদেরকেই যৌতুক নিরোধে দৃঢ প্রতিজ্ঞ হতে হবে। পুরুষ যদি নারীর যর্থাথ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয় তাহলে সমাজ থেকে যৌতুক প্রথার মতো ভয়াবহ ব্যাধি দূরীভূত হতে পারে।

উপসংহারঃ যৌতুক সমাজের জন্য অভিশঅপস্বরুপ । আমাদের যৌতুকের এ অভিশাপের নির্মূলে চলমান সংগ্রাম যে কোনো মূল্যে অব্যাহত রাখতে হবে। যৌতুক ও নারী নির্যাতনের বিষয়টিকে আমাদের আর্থ সামাজিক, সাংস্কৃতি, রাজনৈতিক, আইনগত এবং রাষ্টীয় কাঠামোর প্রেক্ষিতে বিচার বিশ্লেষণ করে সমন্বিত ভাবে প্রয়োজনীয় কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারলেই সমাজ থেকে এ প্রথার নিমূর্ল করা সম্ভব হবে। আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যৌতুকের রাতারাতি নিমূর্ল হবে না । তবে যৌতুকের বিরুদ্ধে অব্যাহত ও দৃঢ প্রতিজ্ঞ কার্যক্রম পরিচালনা সম্ভব হলে সমাজ থেকে একদিন তা অবশ্যই দূরীভূত হবে।

বাংলা রচনাঃ বাংলাদেশের কুটির শিল্প
Previus
বাংলা রচনাঃ শিক্ষাক্ষেত্রে কম্পিউটার
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম