ষড়ঋতুর বাংলাদেশ-ছয়ঋতুর বাংলাদেশ- রচনা/প্রবন্ধ


ষড়ঋতুর বাংলাদেশ

ভূমিকা:  প্রকৃতির অপরূপ লীলা বৈচিত্র্যের কেন্দ্রভূমি আমাদের বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ষড় ঋতুর দেশ। নানা রুপে নানা রঙ্গে আবর্তিত হয় একে একে ছয়টি ঋতু। এদেশের গাছ-পালা, মাটি-বায়ু-জল, ফুল-ফল, পশু-পাখি আর নদী-নালার মত এরূপ বৈচিত্র্যপূর্ণ দেশ পৃথিবীর আর কোথাও নেই। সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলা নিকেতন এদেশ চিরকাল মানুষকে আকৃষ্ট করেছে, ভাবুক করেছে, মোহিত করেছে। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে কবিচিত্ত মুগ্ধ হয়েছে; মুদ্ধ হয়েছে শিল্পী, সাহিত্যিক, চিত্রকর। আর তাইত কবি কণ্ঠে শুনতে পাই-

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।”
গ্রাম বাংলার দৃশ্যাবলিঃ মায়াময়, ছায়াময়, কোকিল-দোয়েল-কোয়েল ডাকা ৬৮ হাজার গ্রাম নিয়ে এদেশ। প্রতিটি গ্রামই প্রকৃতির অপূর্ব দানে সমৃদ্ধ। নানা প্রকার গাছপালায় পরিবেষ্টিত গ্রামগুলো। গ্রামবাংলার বিচিত্র সৌন্দর্য, লাবণ্য, সজীবতা ও সরসতায় চোখ জুড়িয়ে যায়। কবি গেয়ে উঠেন –
“অবারিত মাঠ, গগন ললাট চুমে তব পদধুলি, ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি। পলব-ঘন আম্র-কানন রাখালের খেলা গেহ, স্তব্দ অতল-দীঘি-কালো-জল নিশীথ শীতল স্নেহ।”

ষড়ঋতুর আবর্তনে প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য: বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। ঋতুগুলো হচ্ছে- গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসšত। এ ছয়টি ঋতু চক্রাকারে আবর্তিত হয় এবং প্রকৃতিকে অপরূপ বৈচিত্র্যে বৈচিত্র্যময় করে তুলে। তাই প্রকৃতি প্রেমিকের উচ্চারণ-Bangladesh is the favourite playground of nature, decorated with six seasons.

গ্রীষ্মকাল:  ঋতু আবর্তনের শুরুতেই আসে গ্রীষ্মকাল। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ এ দুই মাস গ্রীষ্মকাল। গ্রীষ্মের প্রচন্ড তাপে খাল-বিল, ডোবা, পুকুর শুকিয়ে যায়। নদ-নদীর পানি কমে যায়। মাঠ-ঘাট খাঁ খাঁ করতে থাকে। সবুজ ঘাসের ওপর পড়ে ধুলারি আ¯তরণ। প্রকৃতিতে কখনো তিন চার দিন গুমোট ভাব বেধে থাকে। আবার কখনো শুরু হয় কাল বৈশাখীর তান্ডব নৃত্য। ভেঙ্গে যায় গাছ-পালা, ঘর-বাড়ি; লন্ডভন্ড করে দেয় সব কিছুকে। অন্যদিকে, বাংলার প্রকৃতি অকৃপণ হাতে উপহার দেয় নানা ধরনের ফল-ফলাদি-আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল ইত্যাদি। গ্রীষ্মের রোদের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবির মুখে শোভা পায় -

“রোদ যেন নয় শুধু ঘন ঘন ফুলকি আগুনের ঘোড়া যেন ছুটে চলে দুলকি।”

বর্ষাকাল:  গ্রীষ্মের পরেই বর্ষা আসে মহাসমারোহে। আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা। শুরু হয় বৃষ্টিপাত। নদী-নালা ও খাল-বিল পানিতে ভরে যায়। অনেক সময় দিনের পর দিন আকাশে সূর্যের মুখ দেখা যায় না। সারা দিন মুষলধারায় বৃষ্টিপাত হয়। আকাশে কালো শেঘ দেখে ময়ূর পেখম তোলে। প্রকৃতিতে ফিরে আসে সজীবতা। কদম, কেয়া, কেতকী, জুঁই, গন্ধরাজ, হাসনাহেনার, বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধ এ ঋতুকে বিমোহিত করে তোলে। জমিতে জমিতে ধান, কৃষকের মুখে হাসির বান। এ প্রসঙ্গে কবি উলেখ করেন-

“বাদলের ধারা ঝরে ঝর ঝর আউসের ক্ষেত জলে ভর ভর কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনিয়েছে দেখ চাহিরে।”

শরৎকাল: বর্ষা শেষে শরৎ আসে তার মনোমুগ্ধকর রূপ নিয়ে। এ রূপের জন্যই শরৎকে বলা হয় ঋতুর রাণী। আকাশে তখন সাদা মেঘ ভেসে বেড়ায়। শরতের মায়াময় রৌদ্র কিরণে প্রকৃতি চঞ্চল হয়ে ওঠে। গাছ-পালা, তরু-লতায় তখন দেখা যায় সবুজের সমারোহ। বর্ষায় অতিবৃষ্টি হলে কখনো কখনো এ ঋতুতে বন্যা দেখা যায়। এ ঋতুর মধ্যেই পাওয়া যায় এদেশের হৃদয়ের চরম স্পর্শের বাণী। এ ঋতুতে শিউলি ফোটা গন্ধ, শুভ্র কাশবন, শাপলা ফোটার সরোবর, আমন ধানের ধানের সবুজ সতেজ বিস্তার এ ঋতুর সৌন্দর্যকে আরও বাড়িয়ে দেয়। সৌন্দর্যপিয়াসি ভাবুক প্রিয় কবির মন তখন আনন্দে গেয়ে উঠে-

“আজিকে তোমার মধুর মুরতি হেরিনু র্শাদ প্রভাতে, হে মাতা ! বঙ্গ শ্যামল অঙ্গ ঝলিছে অমল শোভাতে।”

হেমন্তকাল: শরতের পর আসে হেমন্ত। কার্তিক ও অগ্রহায়ন এই দুই মাস নিয়ে হেমন্তকাল গঠিত। মাঠে মাঠে তখন ফসল কাটার গান। কৃষকের গোলা ভরে উঠে সোনালী ধানে। ঘরে ঘরে চলে নবান্ন উৎসব; আত্মীয়স্বজনকে পিঠাপুলি খাওয়ানোর নিমন্ত্রণ। শীতের আগমনের পদধ্বনি শোনা যায় এ ঋতুর মাঝেই। প্রভাতে সূর্যকিরণে দুর্বাঘাসের ওপরে শিশির বিন্দুগুলো মুক্তার মত উজ্জ্বল হয়ে উঠে। হেমন্ত প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গেয়েছেন -

“কি শোভা কি ছায়া গো কি স্নেহ কি মায়া গো কি আচল বিছায়েছ বটের মূলে নদীর কূলে কূলে।”

শীতকাল:  হেমন্তের পর আসে মাঘের সন্ন্যাসী শীত। পৌষ ও মাঘ এই দুই মাস নিয়ে শীতকাল গঠিত। প্রকৃতি তখন শীর্ণ, ও শুষ্ক থাকে । সর্বত্রই রিক্ততার আভাস। উত্তরে হাওয়া বইতে থাকে। লেপ, চাদর ও গরম কাপড় মুড়ি দিয়ে সবাই শীত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের মন থাকে ক্লান্ত ও নিস্তেজ। এই সময় পাতাহীন গাছের ডালগুলো কেঁদে উঠে বুকফাটা হাহাকারে। কুয়াশা ঢেকে দেয় সবকিছু। তবু খেজুর রসের পায়েস, টাট্কা শাকসবজি, নানা রকমের পিঠা বাঙালীর জীবনে বয়ে আনে খুশির জোয়ার। এ সময় ফোটে বিভিন্ন ধরনের গোলাপ, অতশি আর রজনীগন্ধা ফুল। এ খুশিতে একাত্ম হয়ে কবি লিখেছেন-

“পৌষ-পার্বণে পিঠা খেতে বসে খুশিতে বিষম খেয়ে, আরও উল্লাস বেড়েছে মনে মায়ের বকুনি খেয়ে।”

বসন্তকাল :  শীতের অবসানের পর আসে ঋতুরাজ বসন্ত। ফাল্গুন ও চৈত্র এই দুই মাস নিয়ে বসন্ত ঋতু গঠিত হয়। তখন গাছে গাছে ফুল, ফুলে ফুলে অলি, সুন্দর ধরাতল। পাখির কল-কাকলি, দক্ষিণের হাওয়া, আম্র মুকুলের গন্ধ, ফুলের সমারোহ প্রভৃতি মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব মায়ালোক। এ ঋতুতে কোকিলের কুহুতানে আর পাপিয়ার ডাকে চারদিক মুখরিত হয়ে উঠে। মানুষের প্রাণে তখন আনন্দের জোয়ার। আনন্দে আত্মহারা কবি গেয়ে উঠেন -

“ওগো দখিনা মলয়, আজি তব পরশমে কার কথা পড়ে মনে। মধুপ হয়েছে আজি পাগল পারা কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া।”

উপসংহার:  ঋতু বৈচিত্রের দেশ আমাদের রূপসী বাংলাদেশ। সারা বছর ছয়টি ঋতু পরপর আসে। প্রতিটি ঋতুই মেলে ধরে তার আপন আপন বৈশিষ্ট্য, বৈচিত্র ও সৌন্দর্য। প্রকৃতির এমন রূপ বৈচিত্র্য পৃথিবীর আর কোথাও নেই। তাই তো কবি জীবনানন্দ দাস লিখেছেন -

“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।”

-----------------------00--------------------------

ছাত্রজীবন অথবা,  ছাত্র জীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য - রচনা
Previus
অনুচ্ছেদ
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম