রচনা (প্রবন্ধ)“নারী শিক্ষার গুরুত্ব”


নারী শিক্ষার গুরুত্ব

ভূমিকাঃ
চক্ষু থাকিতে অন্ধ যারা আলোকের দুনিয়ার সিন্ধু সেচিয়ো বিষ পায় তারা অমৃত নাহি পায়।
এরুপ অন্ধত্ব মোচনে শিক্ষার বিকল্প নেই। যেহেতু নারী ও পুরুষ সমাজ দেহের দুুটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, সেহেতু সমাজ গঠনে উভয়ের স্ব স্ব ক্ষেত্রে কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে। আর এ দায়িত্ব বা কর্তব্য পুরুষের পাশাপাশি নারীকে ও বাস্তবমুখী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলতে হবে, যা তাদের জীবন ও কর্মধারার সাথে সম্পৃক্ত।

এদেশে নারীর অবস্থাঃ আমাদের সমাজ ব্যবস্থার নর নারী উভয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার গুরুত্ব সমান ভাবে দেখা হয়নি। আমাদেরকে এ পুরুষশাসিত সমাজে পুরুষের জন্য শিক্ষার সুযোগ ও উদার মানসিকতা যতটুকু আছে নারীদের জন্য ততটুকু নেই। ফলে একই পরিবারের পুরুষেরা শিক্ষার সুযোগ থাকলে ও নারীর ক্ষেত্রে তেমন নেই। তাদেরকে আজ ধর্মীয় অনুশাসনে গৃহকোণে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ফলে এ অভিশাপে আমাদের জাতীয় সৃষ্টি করছে নানা সমস্যা। জাতীয় অগ্রগতি হচ্ছে ব্যাহত।

উন্নত দেশে নারীঃ উন্নত দেশে নারীদের অবস্থান আজ সুদৃঢ । এর প্রধান কারণ হচ্ছে তারা নারী শিক্ষার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। শিক্ষার ক্ষেত্রের পুরুষ ও নারীতে সেখানে কোনো ভেদাভেদ নেই। আমেরিকা, ব্রিটেন, জাপান, জার্মানি, কানাডা প্রভৃতি দেশের নারীরা সকল ক্ষেত্রে পারদর্শী । এসব দেশের নারীরা আজ আর পুরুষেরা মুখাপেক্ষী নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে তারা পুরুষকে অতিক্রম করতে সক্ষম হয়েছে ।

নারী শিক্ষার গুরুত্বঃ নারী শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে আজ কোনো সন্দেহ নেই। নারীরা দেশের মোট জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেক। তাই এ নারীদের অশিক্ষার অন্ধকারে রেখে জাতি কখনো উন্নতি করতে পারে না। এক্ষেত্রে কাজী নজরুল ইসলামের ভাষায় বলতে হয়-

রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিতে রানি, রানির দরদে ধুইয়া গিয়াছে রাজ্যের যত গ্লানি।”
তাই জাতিকে উন্নতি করতে হলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদের শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে। নারীর ভূমিকা মা হলে ও রাষ্ট্রেয় ও অর্থনীতিতে ব্যবসার বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আজ নারী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পুরুষের সাথে নারী কল কারখানায়, মাঠে কাজ করছে। নারীরা এখন প্রধানমন্ত্রীরা বিভিন্ন গুরুত¦পূর্ণ দায়িত্ব পালন করছে। তাই নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয় অপরিসীম।

শিক্ষিত জননী হিসেবে নারীঃ একজন সুশিক্ষিত মাতা জন্ম দিতে পারে একজন সুশিক্ষিত সন্তান, করতে পারে তাকে নিজের আর্দশে আর্দশিত। কারণ ছেলে মেয়েদের উপর মায়ের প্রভাবই বেশী পড়ে। মায়ের কাছ থেকে তারা আচার আচরণ, আদব কায়দা ইত্যাদি শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। শিক্ষা গ্রহন করে থাকে। শিক্ষা ক্ষেত্রে নারীদের প্রভাব সম্বন্ধে বলতে গিয়ে নেপোলিয়ন বলেছিলেন,  “আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেব।”

স্বাবলম্বিতা অর্জনে নারী শিক্ষার গুরুত্বঃ  স্বাবলম্বিতা অর্জনে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। প্রাচীনকালে নারীরা সবকিছুর জন্য তাদের স্বামীদের উপর নির্ভরশীল ছিল। তারা ছিল অবহেলিতা নির্যাতিতা। গৃহ মধ্যেই তাদের কার্যাদি সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু আজ নারীরা শিক্ষিত হওয়ার পাশাপাশি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষিকা, পুলিশ অফিসার. এমনকি সম্প্রতি সশ¯্র বাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে কাজ করছে। তারা আজ সম্পূর্ণরুপে স্বাবলম্বী। সুতরাং আজ আর নারীকে অবহেলা করা কোনো সুযোগ নেই। কবিকন্ঠের সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে হয়-

“সে যুগে হয়েছে বাসি, যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাক হারীরা আছিল দাসী”
গৃহস্থালি কাজে নারী শিক্ষার গুরুত্বঃ  গৃহস্তালি কাজের দিকে তাকালেও দেখা যায় নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম । শিক্ষিতা নারীরা সন্তানের অসুখে-বিসুখে যেভাবে স্বাস্থ্যবিধি অনুযায়ী সেবা,শুশ্রুষা ও সংসারের প্রাত্যহিক আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ করতে পারে, অশিক্ষিত নারীরা সেভাবে করতে পারে না। শিক্ষিতা নারীরা হাতে যদি সংসারের ভার ন্যস্ত থাকে তাহলে সংসারের উন্নতি হবেই। তাই মেয়েদেরকে পুরুষদের ন্যায় শিক্ষিত করে তোলা অত্যাবশ্যক।

দেশ গঠনে শিক্ষার গুরুত্বঃ দেশ গঠনেও নারী শিক্ষার গুরুত্ব অনেক। অতীতে দেশ গঠনে নারীদের যথেষ্ট ভূমিকা ছিল। বর্তমানেও দেশ গঠনে নারীদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে।ভাষা আন্দোলন থেকে এ পর্যন্ত যতটি আন্দোলন হয়েছে প্রত্যেকটি আন্দোলনে নারীদের কিছু না কিছু অবদান রয়েছে। আর এ অবদান রেখেছে শুধু শিক্ষিতা মেয়েরাই। তাই দেশ গঠনে নারী শিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

শিক্ষিত নারীদের সফলতার দৃষ্টান্তঃ  যুগে যুগে শিক্ষিত নারীরা তাদে কর্মপ্রচেষ্টা দ্বারা পৃথিবীতে অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, রাশিয়া, আয়ারল্যান্ড, সুইজেন, নরওয়ে, প্রভৃতি, দেশের নারীরা সাহিত্য, বিজ্ঞান, শিল্পকলা, আন্তর্জাতিক রাজনীতিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। প্রতিভা পাতিল, বেনজীর ভুট্টো, ইন্দিরা গান্ধী, সোনিয় গান্ধী, শ্রীমাভো বন্দরনায়েক, মার্গারেট থ্যাচার, হিলারী ক্লিনটন, কন্ডোলিৎসা, রাইস প্রমুখ এবং তাদের শিক্ষা ও মেধা দ্বারা মহিলা হয়েও বিশ^ব্যাপী পরিচিত। অনুরুপভাবে বাংলাদেশের নারীরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। যেমন সাহিত্য ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল, সেলিনা হোসোন, বেগম রোকেয়া, জাহানারা ইমাম, প্রমুখ এবং রাষ্ট্র পরিচালনায় শেখ হাসিনা ওয়াজেদ যথেষ্ট সাফল্যের দিয়েছেন।

নারী শিক্ষার অন্তরায়ঃ বাংলাদেশে নারী শিক্ষার প্রধান অন্তরায় কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামি। বিশেষ করে পর্দা প্রথার কড়াকড়ির কারণে অনেক মুসলিম নারী ইচ্ছা থাকে সত্ত্বেও শিক্ষাঙ্গনে যেতে পারে না। এ ছাড়া নারী শিক্ষার একটি বিশেষ বাধা হচ্ছে নিরাপত্তার অভাব। নিরাপত্তার অভাবে অনেক অভিভাবকই তাদের কন্যা সন্তানকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পাচ্ছেন। এর সাথে আছে চরম দারিদ্র্য। দারিদ্র্যের নির্মম কষাঘাত থেকে জনগণকে মুক্ত করতে না পারলে শুধু শিক্ষাই নয় দেশের সার্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। সর্বোপরি, দেশের বিপুল সংখ্যক নারীকে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জগতে নিয়ে আসার জন্য যে বিশাল উদ্যোগ , আয়োজন ও প্রতিষ্ঠানিক অবকাঠামো দরকার তা আমাদের নেই। এমতাবস্থায় সর্বস্তরের জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধি ও সরকারি-বেসরকারি সকল পর্যায়ে থেকে উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন না হলে নারী শিক্ষার উন্নয়ন সম্ভব নয়।

নারী শিক্ষা বিস্তারের উপায়ঃ নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য কতিপয় কর্মসূচি গ্রহণ করা জরুরি। যেমন- দেশে নারী শিক্ষার্থীর অনুপাতে প্রয়োজনীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, মেয়েদের সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বয়স্ক নারীদের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ, নারী শিক্ষা প্রসারের জন্য সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলের উদারনীতি ইত্যাদি। নারী শিক্ষা বিস্তারের বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থাবলিঃ নারী শিক্ষা বিস্তারের বাংলাদেশ সরকারের সাম্প্রতিক গৃহীত ব্যবস্থাবলি অনেকটা প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সরকার নারী শিক্ষা প্রসারে স্কুল পর্যায়ে মেযেদের জন্য উপবৃত্তির ব্যবস্থা করেছে। এ উপবৃত্তি ব্যবস্থা ইতোমধ্যে কলেজ পর্যায়ে উন্নতি করা হয়েছে। তা ছাড়া বয়স্ক নারীদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বয়স্ক নারী শিক্ষা কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। বর্তমানে সরকারি উদ্যোগের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি মহলও নারী শিক্ষা প্রসারে নানাভাবে অবদান রাখছে।

উপসংহারঃ

“কোনো কালে একা হয়নিক জয়ী পুরুষের তরবারি প্রেরণা দিয়াছে, শক্তি দিয়াছে বিজয় লক্ষ্মী নারী।”
সুতরাং নারীকে পশ্চাতে রেখে উন্নতির প্রত্যাশা করা দুরাশারই শামিল। তাই অজ্ঞানতার অশুভ অক্টোপাস থেকে নারীকে মুক্ত করতে হবে। আর একমাত্র উপযুক্ত শিক্ষাই বাতলে দিতে পারে নারী মুক্তি পথ।

Country Life and city Life- Composition
Previus
রচনা (প্রবন্ধ) “গ্রাম্য মেলা”
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম