রচনাঃ বসন্তকাল


বসন্তকাল

ভূমিকাঃ
“ওগো দাখিনা মলয়, আজি তব পরশনে কার কথা পড়ে মনে। মধুপ হয়েছে আজি পাগল পারা কুসুমে কুসুমে তাই জেগেছে সাড়া।”

কবিতার এ দখিনা মলয় ইঙ্গিত দেয় প্রকৃতিতে বসন্তের আগমনের। ঋতুচক্রের পালাবদলে সবশেষে আসে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রকৃতিতে রুপের মাধুরী সৃষ্টি করে, ফুলে ফুলে চারদিকে সুশোভিত করে শীতল পরশের মোহনীয়তায় আবির্ভাব ঘটে তার। ঋতুরাজের আগমনে প্রকৃতির পাশাপাশি মানবমনেও জাগে আনন্দের জোয়ার। প্রকৃতিতে প্রাণের স্পন্দন আর মানবমনে ভালোলাগার এক বিমূর্ত অনুভুতি জাগায় ঋতুরাজ বসন্ত। তাই এ ঋতুসবার কাছে পরম কাক্সিক্ষত।

বসন্তের আগমনক্ষণঃ বাংলাদেশে ষড়ঋতুর যে পালাবদল ঘটে তার পরিক্রমার সবশেষে আগমন ঘটে চির কাক্সিক্ষত ঋতুরাজ বসন্তের ফাল্গুন এ চৈত্র এ দুমাস মিলে বসন্তের ব্যাপ্তিকাল স্থায়ী হয়। আর ঋতুচক্রে ভগিনী রিক্ত শীতের পরে তাই প্রকৃতিও তার কাছে হয়ে যায় চির ঋনী। তাই বুঝি তার উদ্দেশ্যে অপেক্ষমাণ প্রকৃতি গেয়ে উঠে।
“ভালোবাসি ভালোবাসি তোমায় যে ভালোবাসি শূণ্য এ জীবনে তোমার এ হাসি।”

বসন্তকে ভালোলাগার কারণঃ ঋতুরাজ বসন্ত ঋতুচক্রের পালাবদলে সবশেষে আগমন করলেও মানবমন তার জন্য সর্ব সময় প্রতীক্ষরত থাকে। কেননা, বর্ণিল ঋতু বসন্তে মানবমন কোনো কিছুর অভাব উপলব্ধি করে না। রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধে সুশোভিত হয়ে ঋতুরাজ আসে প্রকৃতির বুকে। শীতের রিক্ততায় প্রকৃতি হয়ে পড়ে শ্রীহীন। তাই প্রকৃতিও ফিরে পেতে চায় তার অনুপমা রূপ বসন্তের ছোঁয়ায়। বসন্তের পরশ পেয়ে গাছপালাও সজীব হয়ে উঠে। প্রকৃতি গুণগুনিয়ে গায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রচিত চরণ-

“বসন্তের হাওয়া সবে আরণ্য মাতায় নৃত্য উঠে সুন্দরকে অর্ঘ্য দেয় তার, ধন্য তুমি বলে বার বার।”

প্রকৃতির এ স্নিগ্ধতা এসময় মানুষকেও আপ্লুত করে। দাখিনা মলয়, আ¤্রমুকুল আর পুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি তাদের মনে দেয় শান্তির পরশ। তাই বসন্তকে ভালো না লেগে উপায় নেই। ঋতুরাজের আগমন সার্থার হয তার নামের মতোই । রাজার মতো ঐশ^র্যের ভান্ডার নিয়ে দীন প্রকৃতিতে আগমন করে সে এবং করিয়ে দিয়ে যায় প্রকৃতির নিবাস। এ কারণেই সবার কাছে বসন্ত এত প্রিয়।

বসন্তের প্রকৃতিঃ বসন্তের প্রকৃতি স্নিগ্ধ ও পবিত্রতার মোহনীয় আবেশে পরিপূর্ণ থাকে। রিক্ততার দৈন্য বেশভূষা পরিধান করে প্রকৃতি বসন্তের ছোঁয়ায় সিক্ত হওয়ার প্রতীক্ষায় বিভোর থাকে। কেননা, বসন্তের আগমনে ধারতলে ফুল ফোটে, পাখি গান গায়। নব পল্লবে সুশোভিত হয় বৃক্ষরাজি। দখিনের হাওয়া, আম্র মুকুলের ঘ্রাণ সব মিলিয়ে প্রকৃতিতে জাগে প্রাণের জোয়ার। মৃদুমন্দ হাওয়া আর পুষ্পশোভিত প্রকৃতি মানুষের মনকে আন্দোলিত করে। মানবমনের চিরায়ত আবেদন আর প্রকৃতির মোহনীয় পরিবেশের রূপ-রস-গন্ধ মিলে একাকার হয়ে যায়। প্রকৃতির যেদিকে চোখ পড়ে সেদিকেই অনুভূত হয় স্বস্তির নিঃশ্বাস। কোকিলের সুমধুর সঙ্গীত আর বর্ণিত প্রকৃতি এক হয়ে সৃষ্টি করে এক স্বপ্নের মায়ালোক। তাই বুঝি প্রকৃতিতে বসন্তের আগমন ঘটায় মন গুনগুনিয়ে উঠে বিদ্যাপতির মধুর সুরে।

মানবমনে বসন্তের আবেদনঃ মাবনমনে বসন্তের আবেদন চিরন্তন। ঋতুরাজ বসন্ত প্রকৃতির পাশাপাশি মাবনমনেও রঙের জোয়ার আসে। রঙিন প্রকৃতি আর বর্ণিত মানবচিত্তের মধ্যে এক অভূতপূর্ব মেলবন্ধন ঘটায় এ চপলা ঋতু। আবালবৃদ্ধবনিতা বসন্তের রঙে রাঙিয়ে নেয় আপন ভুবন। তাই তো লেখক শংকর বলেছেন, “খেলোয়াড়, অভিনেত্রী এবং নর্তকীর জীবনে মাত্র একটি ঋতুই আছে, তার নাম বসন্ত ঋতু।” মানুষের মনের চিরায়ত আবেদন যেন ভাষা পায় বসন্তের আলিঙ্গণে। মানবমনে বিরাজ উচ্ছলতা আর উচ্ছ্বাসের চঞ্ছলা ভাবাবেগ । ঘরের কোণে মুখ লুকিয়ে বসে থাকার সময় নেই এ বসন্তে। এ ঋতু আনন্দের বারতা নিয়ে আসে এবং মানবমনকেও ভাসিয়ে নেয় আনন্দের জোয়ারে। তাই বেগম সুফিয়া কামাল বলেন-

“আবার বসন্ত রাত্রি আমাদের দুয়ারে দিল হানা উন্মনা ছিলাম আমি তবু সে আমারে ভুলিল না।”

মানবমনে তাই বসন্তের আবেদন এক ভিন্ন মাত্রায় পরিমেয়। চিত্তের দোদুল্যমানতা শতগুণ বাড়িয়ে মানব-মানবীর মনের সংশয়কে ভাষাদানে বসন্তের চেয়ে উৎকৃষ্ট সময় আর নেই। মানবচিত্তে তাই বসন্তের ছোঁয়া পেতে আকুল থাকে সর্বক্ষণ।

বসন্তকে বরণে আয়োজনঃ বসন্তকে বরণ করে নিতে এখন চলে নানা আয়োজনের বাহার। প্রতি বছর ‘পহেলা ফাল্গুন’-এ বসন্তকে স্বাগত জানাতে রঙিন সাজে সাজে উঠে চারপাশ। বর্তমান সময়ে বসন্তবরণ উৎসব যেন এক সর্ববজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে। বাঙালির ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধায়নে এ উৎসব যোগ করেছে এক ভিন্ন মাত্রা। বাসন্তী রঙের শাড়ি, খোঁপায় বেলী ফুলের মালা, রং বেরঙের চুড়ি আর অপরুপ সাজে সুন্দরী ললনারা দলে দলে বেরিয়ে আসে বসন্তের টানে। চারুকলার বকুলতলা, রবীন্দ্র সরোকন ইত্যাদি সাংস্কৃতিক মঞ্চ লোকের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে এদিক। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, মেলা, চুড়ির হাট সব মিলিয়ে চারদিকে সাজ সাজ রব। বসন্তের আগমনে প্রকৃতি সাজে অপরুপ সাজে। প্রকৃতি মানবের একান্ততা চিরন্তন। এ কারণেই প্রকৃতির রঙ রঙিন যেন এ সময় মানবমনকে আরও বেশি অধীর করে তোলে। কোকিলের সমুধুর সুর, পুষ্পশোভিত বৃক্ষরাজি বসন্তের আগমনী বার্তা ঘোষনা করে। তাই বসন্তকে ভালোবেসে আলিঙ্ঘন করে নিতে ভোলে না আবেগী মানুষ। তারাও সাড়ম্বরে গানে গানে সুরে আর ঊষ্ণ ভালোবাসায় আনন্দিত চিত্তে বসন্তকে আপন করে নেয়। বর্তমানকালে বসন্তবরণ উৎসব বাঙালির চিরায়ত ঐতিহ্যকে পুণর্জীবিত করে। বাঙালির মনে বর্ধবরণের মতোই খুশির আমেজ জাগায় এ বসন্তের উপস্থিতি। তাই বুঝি বসন্তবরণের আয়োজন বাণীরুপ পায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়-

“আয়রে বসন্ত তোর ও কিরণ মাখা পাখা তুলি নিয়ে আয় তাের কোকিল পাখীর গানের পাতা গানের ফুলে।”

উপসংহারঃ বসন্তের আবেদন অপরিমেয় ও অকৃত্রিম। কালের পরিক্রমায় এ আবেদন আরও প্রগাঢ় হয়েছে। বসন্তকে বরণ করে নিতে এখন চলে নানা আয়োজন। প্রকৃতির সজ্জা মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হযে বসন্তের আগমন তাই ধন্য হয়ে উঠে। বসন্তের স্পর্শে প্রশান্ত মন গেয়ে উঠে-

“আহা আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত বাঁশি বাজে, কত পাখি গায়।”
রচনাঃ দৈনন্দিন জীবনে বিদ্যুৎ
Previus
রচনাঃ টেলিভিশন
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম