রচনা(প্রবন্ধ)“আমার শৈশব স্মৃতি”


আমার শৈশব স্মৃতি

সূচনাঃ শৈশবের সোনার খাঁচার দিনগুলো আজ আমি একটা বিশেষ বয়সে অবস্থানে করছি। মাঝে মাঝে জীবনের পেছন পানে যখন ফিরে তাকাই তখন শৈশব জীবনের স্মৃতিগুলো সুখ হয়ে ধরা দেয়। সেই দিনগুলো ছিল বড় সুন্দর, বড় রঙিন, বড় মধুময়। জীবন থেকে খসে যাওয়া শৈশবের সেই দিনগুলো আজও ভূলতে পারছি না। যখনই সে দিনগুলো মনে পড়ে তখনই মন পুলকে ভরে উঠে। কত রঙিন ঘটনা, কত উচ্ছ্বাস, কত উল্লাস মনের পর্দায় ভেসে উঠে-

‘সে যে কাল হলো কতকাল তবু যেন মনে হয় সেদিন সকাল,’

বাবার স্মৃতিঃ বাব শুধু আমার জনকই ছিলেন না, তিনি ছিলেন আমার অকৃত্রিম ব›ধু। বাবা আমাকে লেখাপড়া, চলাফেরা সম্পর্কে নানা উপদেশ দিতেন। কী করলে প্রকৃত মানুষ হতে পারব সে কথা বলতেন। স্কুলে পরীক্ষা দিতে যাবার সময় বাবা আমাকে বিভিন্ন উপদেশ দিতেন । বাবা বলতেন- সবাইকে সালাম করতে হবে, দোয়া চাইতে হবে এবং প্রশ্ন বুঝে পরীক্ষার খাতায় উত্তর লিখতে হবে। বাবার এ উপদেশগুলো আমার চলার পথের পাথেয় হয়েছে। তা ছাড়া তিনি নানা মজার মজার গান ও গল্প শোনাতেন। আজ বাবা নেই, কিন্তু বাবার কথাগুলো আজো আমার মনে অক্ষয় হয়ে আছে। মায়ের স্মৃতিঃ মা আমার শৈশব, কৈশোর, এমনকি আমার পুরো অস্তিত্ব জুড়ে বিরাজমান। সত্যিকথা বলতে গেলে আমার সবকিছুই মূলে মার অবদানই সবচেয়ে বেশি। মা যে আমাকে কতটুকু ভালোবাসতেন তা বর্ণনা ভাষা আমার জানা নেই। তবে এতটুকু বলতে পারি, মা তাঁর জীবনের চেয়েও আমাকে বেশি ভালোবাসতেন । আমাকে সুখী দেখলে মা খুব খুশি হতেন, আমি একটু অসুস্থ হলে মা উতলা হয়ে যেতেন । স্কুল বা অন্য কোথাও থেকে বাড়ি ফিরতে একটু দেরি হলে মা উদ্বিগ্ন চিত্তে বাড়ির সামনে দাড়িয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতেন। মায়ের সমুদয় স্মৃতি আজ মনে হলে আমার পক্ষে নিজেকে সামলানো কষ্ট হয়। আজ মা নেই আমার কাছে তবুও-

মধুর আমার মায়ের হাাসি চাদের মুখে ঝরে মাকে মনে পড়ে, আমার মাকে মনে পড়ে”

লেখাপড়ার স্মৃতিঃ ছোটকাল আমি ছিলাম দুষ্টের শিরোমণি। হৈ-চৈ সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখতাম। একদিন বাবা বললেন, তোমাকে পড়া শুরু করতে হবে। পরদিন নতুন জামা-কাপড় পরে, নতুন বাই-খাতা কলম নিয়ে বাবার সাথে স্কুলে গেলাম। বাবা মাস্টার মহাশয়কে সালাম দিতে বললেন- আমি সালাম দিলাম। মাস্টার মহাশয় হাসি দিয়ে সালামের উত্তর দিলেন এবং আমাকে আদর করে কাছে বসালেন। তারপর যত্নের সাথে বই খুলে পড়া বলে দিলেন- অ, আ, ই, ঈ। আমি মনোযোগ দিয়ে দীর্ঘ সময় পড়েছিলাম। তারপর শুরু হলো স্কুলে যাওয়ার পালা। সমবয়সীদের সাথে স্কুলে যেতাম, ভালোই লাগত। এভাবে স্কুলে যাওয়া-আসা,শিক্ষকগণের আদর-- স্নেহ -শাসন আর বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা – খুনসুটির মধ্য দিয়ে আমার শৈশবের স্কুল জীবনের দিনগুলো বিশিষ্টতা লাভ করেছিল।

বৃষ্টির দিনের স্মৃতিঃ শৈশব বৃষ্টির দিন আমার কাছে আর্শীবাদের মতো মনে হতো। প্রতিদিনের ছকে বাধাঁ জীবন থেকে ক্ষণিকের মুক্তি মিলত যেন। কারণ বৃষ্টি হলে স্কুলে যেতে হতো না। সেদিন আমার কী আনন্দ! ভাই-বোনেরা মিলে বারন্দায় নেচে, গেয়ে বৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠতাম। মায়ের বকুনি, বাবার শাসন-কে শোনে কার কথা। হৈ-হল্লা করে বাড়ি মাতিয়ে তুলতাম। কখনো আবার বৃষ্টির তালে তালে সুর করে গান ধরতাম-

মেঘের কোলে রোদ হেসেছে বাদল গেছে টুটি আজ আমাদের ছুটি ও ভাই আজ আমাদের ছুটি।

পাড়া বেড়ানোর স্মৃতিঃ রোজ বিকেলে ব›ধুদের নিয়ে সারা পাড়া বেড়ানো ছিল আমার রুটিনের মতো। তাদেরকে নিয়ে এ পাড়া ও পাড়া বেড়াতাম। গোসলের সময় সবাই মিলে পুকুরে, জলাশয়ে সাতাঁর কাটতা। কে কত ডুব দিতে পারে, কে কতক্ষণ পানির নিচে থাকতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নামতাম। কোনো দিন বিকালে ফুটবল খেলতে মাঠে যেতাম। হা-ডু-ডু খেলা, গাছে চড়া, আমার প্রিয় ছিল। গাছে চড়ে আম পাড়া, জাম মুখ রঙিন করা মজার ব্যাপার ছিল। আজ যখন কালেভদ্রে অবসর-অবকাশে হারানো শৈশব খুঁজে পাওয়ার প্রত্যাশায় নজরুলের লিচু চোর’ পড়তে শুরু করি।

“হাবুদের তালপুকুরে বাবুদের ডালকুকুরে সেকি বাস করলে তাড়া বলি থাম একটু দাঁড়া।”

তখন, ‘লিচু চোরের’ সাথে শৈশবের অনেক সামঞ্জস্য দেখে বড়ই পুলকিত হই।

মামাবাড়ির স্মৃতিঃ মামার বাড়ি আমার শৈশবের এক বিরাট অংশ জুড়ে আছে। মামার বাড়ি বেড়ানো, সেখানে সকলের স্নেহ- আদর আমার জন্য ছিল স্বগীয়। স্কুল ছুটি হলে মায়ের সাথে মামার বাড়ি বেড়াতে যেতাম। আমরা নৌকা করে যেতাম। মাঠের বুক চিরে জলের উপর দিয়ে ভেসে ভেসে যাওয়া সে কী আনন্দ। যখন মামার বাড়ি পৌছাতাম, তখন নানি আমাদেরকে কত আদর করতেন, নাড়ু, চিড়া, মুড়ি, পিঠা খেতে দিতেন। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ মাসে মামার দেশে কালবৈশাখীর ঝড় কিংবা কাঠফাঁটা রোদে আমাদের দুরন্তপনার স্মৃতি আমাকে আজও উন্মনা করে দেয়। মনে পড়ে কবি জসীমউদ্দীনের-

“ঝড়ের দিনে মামার দেশে আজ কুড়াতে সুখ পাকা জামের মধুর রসে রঙিন করি মুখ।”

বন্ধুর স্মৃতিঃ শৈশবকালের এত সুখের স্মৃতির মাঝে একটি স্মৃতি আমাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়, বেদনা দেয়। আমার বন্ধু ছিল সোহেল। একবার তার ভীষণ জ্বর হয়েছিল। খবর পেয়ে তাকে দেখতে গেলাম। গিয়ে দেখি সে বিছানায় ছটফট করছে, তার মা-বাবার কাঁদছে। আমি তার পাশে বসে জিজ্ঞেস করলাম- সোহেল, তোর কেমন লাগছে? সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল-সোহাগ, আমার ছুটি হয়েছে

, তোরা সুখে থাক, আমি চললাম। দেখতে দেখতে সে চলেই গেল। সেদিন বুঝেছিলাম প্রিয়জন হারাবার বেদনা কত কঠিন। উপসংহারঃ ফেলে আসা দিনগুলোর কথা স্মরণ করতে গেয়ে বুঝলাম কত জীবন্ত হয়েই না সেই দিনগুলো আমার মনে আজো রয়ে গেছে। আজ শৈশবের কত কথাই মনে পড়ছে। জীবনের অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। কত স্মৃতি এসে জীবনের পাতার জমা হয়েছে। কিন্তু শৈশবের সেই সোনাঝরা স্মৃতি কোনোভাবেই যায় না। অনেক সময়ই ভাবি, শৈশব জীবন যদি আবার ফিরে পেতাম। কিন্তু তা তো কখনো সম্ভব নয়। তাই তো কবি গুরুর মতো আমারও বলতে ইচ্ছে হয়- “দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না, রইল না সেই যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।”

আমার জীবনের লক্ষ্য - রচনা
Previus
Gazi Online School
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম