বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা-রচনা/প্রবন্ধ


বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

ভূমিকা: প্রয়োজনই উদ্ভাবনের প্রেরণা যোগায়। বিজ্ঞান এসেছে মানুষের প্রাত্যহিকতার প্রযোজনে। মানুষের অভাবরোধ থেকে বিশেষ জ্ঞান হিসেবে বিজ্ঞানের উৎপত্তি। আভিধানিক অর্থে বিশেষ জ্ঞাই হলো বিজ্ঞান। সাহিত্যিক প্রমথ চৌধুরী বিজ্ঞানের একটি সুন্দর সংঙ্গা প্রদান করেছেন- ‘বিজ্ঞান শুধু একটি বেশেষ জ্ঞানের নাম নয়, একটি বিশেষ প্রণালি অবলম্বন করে যে জ্ঞান লাভ করা যায়, আসলে তারই নাম হচ্ছে বিজ্ঞান।” অক্সিজেন ছাড়া যেমন প্রাণিকুলের জীবন ধানণের কথা কল্পনা করা যায় না, তেমনি বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতাকে কল্পনা করা যায় না।

বিজ্ঞান শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ব গুরুত্ব: বিজ্ঞানের বলে মানুষ জল-স্থল, অন্তরীক্ষ জয় করেছে; সংকট নিরসন ও অসংখ্য সুখ-স্বাচ্ছন্দ্র বিধানের বহু অভাবনীয় কৌশল আবিষ্কার করেছে। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আজ বিজ্ঞানের জয়যাত্রা পরিলক্ষিত হয়। কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের সার্বিক উন্নতি নির্ভর কের বিজ্ঞানের ব্যাপক বিস্তার ও বিকাশে। ছোট বড় কলকাখানা গড়ে তোলা, কৃষির উন্নতি , চিকিৎসাক্ষেত্রে উন্নয়ন, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, কুসংস্কার দূরীকরণ, বেকারত্ব লাঘব, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ইত্যাদি কাজে বিজ্ঞানের অবদান অনস্বীকার্য। মানুষ বিজ্ঞানকে জীবনযাত্রার সহচর করে জীবনকে করে তুলেছে সহজ ও উপভোগ্য । এককথায়, মানব সভ্যতাকে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত করেছে বিজ্ঞান। কাজেই বিজ্ঞান শিক্ষার গুরুত্ব অপরীসীম।


বিজ্ঞান শিক্ষার প্রভাব ও সুফল: যে শিক্ষা ধারাবাহীক বিশ্লেষণপন্থী ও বাস্তবসম্মতÑবিজ্ঞান আমাদের সে শিক্ষা দেয়। বিজ্ঞান আমাদের জ্ঞানান্ধকার দূর করে সঠিক জ্ঞানের আভাস দেয় এবং মনুষ্যত্বের জাগরণ ঘটিয়ে আত্মোপলব্ধি তথা বিশ্বজগতের স্বরূপ উপলব্ধিতে সাহায্য করে। বিজ্ঞান শিক্ষা কুসংস্কার বিনাশকারী। ধর্মের নামে যারা গোঁড়ামিকে প্রশ্রয় দেয়, প্রকৃত বিজ্ঞান তাদেরও সচেতন হতে সাহায্য করে। যারা বিজ্ঞানশিক্ষা অর্জন করেছেন, তারা কখনো ‘নজর’ লেগে সন্তান রোগা হয় ,গাছের ফল ঝরে যায় বা গাছ মনে যায়- এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করেন না। স্বপ্ন দেবী কাউকে কোনো ক্ষমতা প্রদান করেছেন এমনটিও বিজ্ঞানের মতে গুরুত্বহীন। বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিতরা যে কোনো ঘটনা বা সমস্যার প্রকৃত কারণ জানতে সচেষ্ট হয়। তাই কুসংস্কার থেকে মুক্তি ও বিজ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে বিজ্ঞাচর্চার বিকল্প নেই।

সমাজজীবনে বিজ্ঞান শিক্ষার প্রভাব:  আমাদের সমাজে বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার মানুষ বাস করে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে তাদের প্রত্যেকের জীবনেই বিজ্ঞানশিক্ষার প্রভাব ও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিজ্ঞানের জ্ঞান আজ তাদেরকে করে তুলেছে কর্ম,কুশলী, নিয়মনিষ্ঠ, নিরলস ও সুশৃঙ্খল। বিজ্ঞান বিষয়ে সামান্যতম জ্ঞানের অধিকারী ব্যক্তিও চাষাবাদের ক্ষেত্রে বা পানি সেচের ক্ষেত্রে প্রকৃতির উপর নির্ভশীল না থেকে বিকল্প কোনো উপায়ে সমস্যার সমাধান করে নিচ্ছে। তা ছাড়া উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ওষুধ ব্যবহাে রর মাধ্যমে কৃষিবিপ্লব ঘটাতে সচেষ্ট হচ্ছে। বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির সাফল্য দেখে সমাজের অন্যরাও অনুপ্রাণিত হয় । আবার শিল্প কারখানায় অনেক ধরণের যন্ত্র ব্যবহার করতে হয়। সংশ্লিষ্ট শ্রমিকেরা যদি বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাহলে উৎপাদন বেশি হয় এবং দুর্ঘটনার সম্ভাবনা কম থাকে। আজকাল পুকুরে মাছ চাষ করতে হলেও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে করতে হয়, নতুবা আশানুরুপ সাফল্য লাভ করা যায় না। গরু ,হাঁস, মুরগি, মাছ, ইত্যাদির উৎপাদন বৃদ্ধি করতে চাইলে সংশ্লিষ্টদের বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়া জরুরি। ধান, গমসহ মানুষের খাদ্যের উপপাদন বৃদ্ধিতেও বিজ্ঞানশিক্ষাও প্রভাব অনস্বীকার্য।

দেশ ও জাতি গঠনে বিজ্ঞানশিক্ষা:  মানুষের অভাবরোধ থেকে জ্ঞান হিসেবে বিজ্ঞানের উৎপত্তি বলেই জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে বিজ্ঞানের সম্পর্ক খুবই নিবিড়। তাই দেশ ও কজাতি গঠনের ক্ষেত্রে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। যে কোনো উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে প্রচুর চিকিৎসক ও প্রকৌশলীল যেমন দরকার , তেমনি কৃষিবিজ্ঞানী ও পশূবিজ্ঞানীও খুবই প্রয়োজনীয়। বিজ্ঞানের কল্যানেই মানুষ মরুভুমির ঊষর বালুকায় শস্য উৎপাদন করতে পারছে। বিজ্ঞানের শক্তিই আজ মানুষকে দিয়েছে নতুনতন স্বপ্নের স্বর্গরাজ্য গড়ে তোলার সার্থক ও সুন্দর সুযোগ। বিজ্ঞানের জ্ঞান ব্যবহার করেই মানুষ তার সংকট থেকে উত্তরণ ও সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য হাজারো কৌশল পদ্ধতি আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছে। যে জাতি বিজ্ঞান শিক্ষায় আজ যত বেশি আগ্রসর , তারা তত বেশি উন্নতি লাভ করছে দেশ ও জাতি গঠনের সর্বক্ষেত্রে । কারিগরি বিজ্ঞান শিক্ষায় মাধ্যমে অনেকে নিজের ভাগ্য বদলাতে সক্ষম হচ্ছে। তাই বলা যায়, দেশ ও জাতি গঠনে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম।

বিজ্ঞানশিক্ষার বিভিন্ন স্তর ও প্রভাব: বিজ্ঞানশিক্ষার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। যেমন- উচ্চতর, মাধ্যমিক ও প্রাথমিক প্রত্যেক মানুষকেই বিজ্ঞান সম্পর্কে অন্তত প্রাথমিক জ্ঞান বা শিক্ষা অর্জন জরুরি। যাদের পক্ষে মাধমিক পর্যায়ের বিজ্ঞান শিক্ষা গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে, তাদের পক্ষেই জীবন সংসারের বিভিন্ন জটিল বিষয় উপলব্ধি করা সম্ভব । আবার যারা উচ্চতর পর্যায়ের শিক্ষা গ্রহন করতে পারে, তারা নতুন কোনো প্রযুক্তির উদ্ভাবনে সক্ষম হবে। প্রাথমিক জ্ঞানসম্পন্ন ব্যাক্তিদের সাধারণ কোনো রোগ বা সমস্যায় ফকির বা কবিরাজ ডাকতে হয় না। ব্যাক্তিগতভাবে সমস্যার সমাধানে অক্ষম হলে তারা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে, অভিঙ্গদের সঙ্গে যোগাযোগ বা পরামর্শ করে। ব্যবহারিক জ্ঞান থাকার কারণে সাধারণ মানুষও আজ টেলিভিশন, ভিসিডি, ভিসিআ, স্যাটেলাইট চ্যানেল, কম্পিউটার, মোবইল, ইন্টারনেট ব্যাবহার মাধ্যমে ক্লান্ত ও অবসাধগ্রস্ত প্রতিটি মুহুর্তকে আনন্দঘন করে তুলতে পারছে।


বিজ্ঞান শিক্ষা প্রসারে উদ্যোগ প্রয়োজন: বিজ্ঞানের সুফল ভোগ করতে হলে আবিষ্কারসমূহের ব্যবহার সম্পর্কে জ্ঞান থাকা চাই। এ জ্ঞানার্জনের জন্য বিজ্ঞান শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। পুঁথিগত ও ব্যাবহারিক জ্ঞানের সমন্বয়েই বিজ্ঞানের সুফল সর্বোচ্চভাবে ভোগ করা সম্ভব। তাই জাতিকে বিজ্ঞান শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ করতে হবে । এ জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন জরুরি।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিজ্ঞান শিক্ষা: বর্তমান বিজ্ঞাননির্ভর যুগে এসেও বাংলাদেশ বিজ্ঞানশিক্ষায় পিছিয়ে আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যখন বিজ্ঞানশিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে উন্নতির দিকে ছুটে চলছে তখন আমরা প্রাচীনপন্থী মনোভাব নিয়ে বিজ্ঞান বিমুখ হয়ে আছি। ব্রিটিশদের কেরানি তৈরি করার যে শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশে প্রচলিত আছে, তাতে বিজ্ঞান শিক্ষার তেমন সুযোগ নেই। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আমাদের এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার করে বিজ্ঞাভিত্তিক শিক্ষা ব্যাবস্থা গড়ে তুলতে হবে। তা ছাড়া দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানশিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

উপসংহার:  ব্যাক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র তথা জীবনের সর্বস্তরে বিজ্ঞানশিক্ষার গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনকে গতিময় রাখার জন্য চাই বিজ্ঞানশিক্ষা। আদিম যুগ থেকে আরম্ভ করে বর্তমান যুগ পর্যন্ত মানব সর্ভতার যে বিকাশ ঘটেছে, তার মূলে রয়েছে বিজ্ঞান । বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে আধুনিক সভ্যতা কল্পনাও করা যায় না। তাই আমাদের প্রত্যেককে বিজ্ঞানশিক্ষায় আন্তরিক হতে হবে।

স্বদেশ প্রেম (দেশপ্রেম) -রচনা (প্রবন্ধ)
Previus
চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান - রচনা/প্রবন্ধ
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম