বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য -রচনা/প্রবন্ধ


বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ভুমিকা:  বঙ্গোপসাগরের বিস্তীর্ণ জলরাশির বুক চিরে গাঙ্গেয় অববাহিকায় সগর্বে জেগে উঠা পৃথিবীর বৃহত্তম ব দ্বীপ আমাদের এ প্রিয় বাংলাদেশ। এক লক্ষ সাতচল্লিশ হাজার পাঁচশত সত্তর বর্গ কিলোমিটারে উর্বর পলল-সমৃদ্ধ ছোট্ট এই দেশটি রূপবৈচিত্র্যের বিচারে পৃথিবীতে এক অনন্য স্থান দখল করে আছে। সাগরের গর্জন, অসংখ্য নদীর বহমানতা স্থলভাগের সবুজ শ্যামলিমা, সংস্কৃতিক স্বাতস্ত্র্য আর অতুলনীয় ঋতুবৈচিত্র্যের পটভুমিতে এদেশে যে অনুপম দৃশ্যের অবতারণা হয় তা মানুষ মাত্রকে মুহুর্তেই ভাবুক করে তোলে । তাই মনের অজান্তেই কবিমন গেয়ে উঠে। -

“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি।”

সমুদ্র সৈকত: বাংলাদেশের কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। এ ছাড়া কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত বিশ্বের আকর্ষনীয় সমুদ্র সৈকতগুলোর একটি । বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অন্যন্য স্বাক্ষর এ দুটি সমুদ্র সৈকত। ফেনিল সাগরের সুনীল বুকে সূর্যোদয় ও সূর্যোস্তের যে মোহনীয় আবেশ এ দুটি সৈকত সৃষ্টি করে তা দেশি -বিদেশি পর্যটকদেরকে দুর্বার বেগে আকর্ষন করে। এ দুটি স্থানের নন্দনিক সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষকে আবেশে উন্মনা করে দেয়।

নদ-নদী ও হাওর-বাঁওড়:  বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। পদ্মা, মেঘনা, ঘমুনা, ব্রহ্মপুত্রসহ অসংখ্য নদী সারাদেশে জলের মতো ছড়িয়ে থেকে এর রূপবৈচিত্র্যে সৃষ্টি করেছে এক অসাধারণ আমেজ। নদনদীর ভূমিকাতেই শস্য-শ্যামল ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ। মাঠের সবুজ , ফসলের হাসি, কিংবা বন- বনানীর শ্যামলতা নদনদীর জলধারার গৌরববেই প্রকাশ করে। নদীল বুকে পানকৌড়ি, গাংচিলসহ অসংখ্য পাখির জলকেলি আর সারি বেধে বয়ে চলা রং বেরঙের পালতোলা নৌকার দৃষ্টি নন্দন রূপ হৃদয় মনে এক অনির্বচনীয় আনন্দের সৃষ্টি করে। তদুপরি পালতোলা নৌকার উদাস মাঝি আনমনে যখন গেয়ে উঠে-

“মন মাঝি তোর বৈঠা নে-রে আমি আর বাইতে পারলাম না।”

তখন আমাদের হৃদয়ও যেন হারিয়ে যেতে চায় দূর অজানায় । অপরদিকে পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জজুড়ে অবস্থিত চলনবিল এবং সিলেট অঞ্চলের হাকালুকি হাওরসহ অসংখ্য হাওর -বাওড় এদেশের পরিবেশ ওজীববৈচিত্র্যে বিশিষ্টতা দান করেছে। তাই আজ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যে সংরক্ষণে এ গুলো আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।

বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল:  বাংলাদেশের বেশিরভাগ স্থান পলিগঠিত বিস্তীর্ণ সমভূমি অঞ্চল। উর্বর এ সমভূমি অঞ্চলে দৃষ্টিগোচর হয় সবুজের সমারোহ। সমুখের বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকালে মনে হয় এ যেন সবুজের বিশাল সমুদ্র। শস্যসম্ভবা তৃণরাশি যখন মৃদুমন্দ বাতাসে আলোড়িত হয় তখন মনে হয় সবুজ ঊর্মিমালা ধেয়ে যাচ্ছে দিগন্তের পানে। আর এমনই কোনো অপরূপ মুহুর্তে কবিমন অকস্মাৎ গেয়ে উঠে-

“ধানের ক্ষেতে বাতাস নেচে যায় দামাল ছেলের মতো ডাক দে বলে আয়রে তোরা আয় ডাকব তোদের কত।”

পাহাড়িয়া অঞ্চল: পাহাড়িয়া অঞ্চল বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যকে সমৃদ্ধতর করেছে। এ অঞ্চলটি বৃহত্তর ময়মনসিংহ , সিলেট, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামজুড়ে বিস্তৃত।ময়মংসিংহের মধুপুরের গড়, গাজীপুরের ভাওয়ালের গড় ও কুমিল্লা লালমাই পাহাড় যেন অপার সৌন্দর্যের আধার। এ  ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়িয়া অঞ্চল, গারো পাহাড়ের পাদদেশ ও সিলেটের সবুজে ছাওয়া বিস্তীর্ণ চা বাগানসহ সমগ্র পাহাড়িয়া অঞ্চল জীববৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।

পল্লি প্রকৃতি: বাংলাদেশ গ্রাম প্রধান দেশ। এখানে শতকরা ৮০ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। প্রকৃতির অপরূপ রূপবৈচিত্র্য গ্রামবাংলাকে ঋদ্ধ করেছে। গ্রামের সৌন্দর্য অকৃত্রিম। যতদূর দৃষ্টি যায় সবুজ মাঠ আর সোনালি শস্যের কাকচক্ষু জলে ফুটে থাকা শাপল কিংবা পদ্মের সৌন্দর্য মানুষকে মুদ্ধ করে। ক্লান্ত রাখালের অপূর্ব বাশিঁর সুর দশদিক আলোড়িত করে। চিরন্তর গ্রামবাংলার এই নয়নাভিরাম স্যেন্দর্য মুগ্ধ কবি গেয়ে উঠেছেন-

“অবিরিত মাঠ, গগন ললাট্, চুমে তব পদধুলি ছায়া সুনিবিড় .শান্তির নীড়, ছোট ছোট গ্রামগুলি পল্লব ঘন আম্র কানন রাখালের খেলাগেহ স্তব্ধ অতল দীঘি কালো জল নিশীখ শীতল স্নেহ।”

ঋতুবৈচিত্র্য:  পৃথিবীর অধিকাংশ দেমের চারটি ঋতু পরিলক্ষিত হয়। এগুলো গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত, বসন্ত। কিন্তু বাংলাদেশে দ্বিতীয় ও তৃতীয় ঋতু হিসেবে বর্ষা ও শরৎসহ মোট ছয়টি ঋতুর আবির্ভাব ঘটে। আর প্রটিটি ঋতু প্রকৃতিতে বিচিত্র রূপমাধুর্যের সৃষ্টি করে। বছরের শুরুতে নতুনের বার্তা নিয়ে আগমন ঘটে গ্রীষ্মের। এর আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ ও বিশুষ্ক হয়ে উঠে। হারিয়ে যায় সবুজ প্রকৃতির শ্যামর শোভা । ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে আসে কালবৈশাখী। প্রকৃতিকে নবরূপে সজ্জিত করার জন্যই বুঝি গ্রীষ্মের এই দুর্দান্ত আগমন। অতঃপর বজ্রের কাড়া-নাকাড়া বাড়িয়ে, বিদ্যুতের পতাকা উড়িয়ে বর্ষা আসে দিগি¦জয়ী যোদ্ধার মতো। প্রকৃতির সমগ্র অবয়বে বর্ষা আনে এক সতেজ কোমলতা। বৃষ্টির অঝোর ধারায় গাছে গাছে, পাতায় পাতায় লাগে শিহরণ, জাগে সজীবতা,। আর এই সজীবতা দোলা দেয় মানব মনকেও। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়-

“এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়।”

বর্ষা যখন অলস মন্থর, একঘেয়েমি আর বিষন্ন বিধুর নিঃসঙ্গতায় রূপন্তরিত হয় ঠিক সেই মুহুর্তে মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলতে হালকা চপল ছন্দে শরৎ আসে। এ যেন একটু মেঘ, এক পশলা বৃষ্টি , এক ঝলক হাওয়া আর পারক্ষনেই সোনালি রোদ্দুর । এ সময় বাতাসে এক খুশির সুর বেজে উঠে। এরপর আসে হেমন্ত । সাঁঝের পর হালকা কুয়াশায় জোনাকির মিটিমিটি জ্বলার দৃশ্য প্রত্যক্ষ করা যায় এ ঋতুতেই। এই আলো -আঁধারি কুয়াশা গায়ে মেখেই বড় কুন্ঠিত পদক্ষেপে সমৃদ্ধি নিয়ে কৃষকের দুয়ারে আবির্ভূত হয় হেমন্ত। হেমন্তের উৎসবমুখর গ্রমাবাংলার হিমেল পরশ বুলিয়ে একদিন শীত আসে। প্রকৃতি এ সময় যেন সমস্ত সাজ সজ্জা ফেলে দিয়ে রিক্ত রৈাগীল রূপ পরিগ্রহ করে। অপরদিকে বিচিত্র বর্ণ ও গন্ধের ফুলে ফুলে প্রকৃতির আচঁল ভরে উঠে। অবশেষে মাঘের তুহিন শীতল বন্ধন ছিন্ন করে বেরিয়ে আসে সুসজ্জিতা ফাগুন , আসে বসন্ত তার রাজসিক রুপমাধুর্য নিয়ে । সবুজ কিশলায় বিকশিত হয় পত্রহীন শূণ্য বৃক্ষশালা। অশোক পলাশ কৃষ্ণচুড়া আর শিমুলের বনে যেন আগুন লাগে রক্তরঙিন ফুলের । এভাবে ছয়টি ঋতুর পালাবদলে বাংলার প্রকৃতি হয়ে উঠেছে রুপমাধুর্যের এক অপরুপ লীলাকেন্দ্র।

উপসংহার: সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই বাংলাদেশের অপরুপ সৌন্দর্য পৃথিবীখ্যাতে। এদেশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে সৌন্দর্যপ্রেমীরা যেমন ঘর ছেড়েছে, তেমনি বিদেশি পর্যটকেরাও ছুটে এসেছে। প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য মানুষের মনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছে, যা যুগে যুগে বাংলায় কালজয়ী গীতি-কাব্য সাহিত্য সৃষ্টিতে অবদান রেখেছে। বাংলার তুলেছে। আর এজন্যই বাংলাদেশে পৃথিবীর অন্যতম সুরম্য লীলা নিকেতন।

জাতি গঠনে নারী সমাজের ভূমিকা-রচনা
Previus
ষড়ঋতু অথবা, বাংলাদেশের ঋতু বৈচিত্র্য - রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম