কৃষিকাজে বিজ্ঞান/কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান-রচনা/প্রবন্ধ


কৃষিকাজে বিজ্ঞান অথবা, কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অবদান

সূচনা: বর্তমান সভ্যতা বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ট। বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারের জাদুকরী স্পর্শে মানবজীবনের সর্বত্র এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সর্বক্ষেত্রে আজ পরিলক্ষিত হচ্ছে বিজ্ঞানের অব্যাহত জয়যাত্রা। কৃষিক্ষেত্রেও জয়যাত্রা লক্ষনীয়। সারা বিশ্বে বিজ্ঞানের অভিনব আবিষ্কারের প্রেক্ষিতে কৃষিক্ষেত্রে এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন।

কৃষির অতীত কথা: কৃষিই মানব আদিমতম পেশা। তবে সুদূও অতীতে কৃষি ব্যবস্থা বলতে কিছুই ছিল না। জীবন ধারণের তাগিদে আদিম অধিবাসীরা ফল-মূল সংগ্রহ করত এবং মাছ ও জন্তু-জানোয়ার শিকার করত। অনেক সময় বুনো খাবার একেবারেই জুটত না। ফলে খাদ্যের সন্ধানে তারা এক স্থান থেকে ঘুরে বেড়াত। অবশেষে তারা পশূ পালন ও বীজ বপন করতে শেখে। এরই ফলে খাদ্যদ্রব্য সুলভ হয় এবং জীবনযাত্রা হয়ে উঠে অপেক্ষাকৃত সহজ। তবে তখন কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং চাষপদ্ধতি এতটা উন্নত ছিল না । সময়ের ব্যবধানে বিজ্ঞানের অবদানে কৃষিক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।

কৃষিতে বিজ্ঞানের অবদান: বিজ্ঞান আজ উর্বরতা দিয়ে ক্ষয়িষ্ণু বসুধাকে শস্যবতী করে তুলছে। আদিম প্রযুক্তির লাঙল, মই প্রভৃতি পরিহার করে বর্তমান ট্রাক্টরের সাহায্যে অতি স্বল্প সময়ে, স্বল্প পরিশ্রমে অধিক পরিমাণ জমি চাষাবাদ করা হচ্ছে। বীজ উৎপাদ ও সংরক্ষণে বিজ্ঞানের সহায়তা নেয়া হচ্ছে। সার, সেচ, ইত্যাদি ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের ব্যবহার হচ্ছে। ভেটেরেনারি সায়েন্স বা পশুরোগ সংক্রান্ত বিজ্ঞান খামারের পশুদের মধ্যে রোগজনিত মৃত্যুহার বহুলাংশে হ্রাস করেছে। গাছপালা ও শস্যদির মধ্যে নানা ধরনের পতঙ্গের উৎপাত, জীবাণু সংক্রামণ ও রোগ থেকে মুক্তির উপায় বের করেছে বিজ্ঞান। সর্বোপরি, বিভিন্ন কৃষিজ ফসল নিয়ে গবেষনা করে উন্নত মানের ও অধিক ফলনশীল বীজ আবিষ্কার করা হয়েছে।

আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি: কৃষি খামারের আধুনিক যন্ত্রপাতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বৈদ্যুতিক দোহর যন্ত্র (মিল্কার), শীতলকারী যান্ত্র ( কুলার) , মাখন তোলার যান্ত্র ( ক্রিম সেপারেটর), ভোজ্য দ্রব্য পেষক যন্ত্র ( ফিড গ্রাইন্ডার), এবং সার ছিটাবার যন্ত্র ( ম্যানিউর স্প্রেডার) ইত্যাদি। সেল্ফ বাইন্ডার বা স্বয়ং বন্ধনকারী যন্ত্র ফসল কাটার সঙ্গে সঙ্গে শস্যের আঁটি বাঁধে। আর ‘কম্বাইন হারভেস্টের’ যন্ত্রটি একই সাথে ফসল কাটে এবং ঝাড়াই - মড়াই করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া প্রভৃতি দেশের খামারগুলোতে শক্তিশালী এক একটি ট্রাক্টর তিন চারটি ফসল কাটার যন্ত্রকে একসঙ্গে কাজে লাগায় এবং ১০০ একর পর্যন্ত জমির কাজ একদিনে সম্পন্ন করতে পারে।

উন্নত বিশ্বের কৃষি ব্যবস্থাপনা: বর্তমান বিশ্বের অনেক দেশই কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারকে কাজে লাগিয়ে সাফল্য লাভ করছে। এসব দেশে জমি কর্ষণ, বীজবপন, সেচকাজে , ফসল কাটা, মাড়াই বাছাই ইত্যাদি সব কাজেই যন্ত্রের সাহায্যে সম্পাদন করা হয়। শীতপ্রধান দেশগুলো গ্রিনহাউজের সাহায্যে গ্রীষ্মপ্রধান দেশের মতো শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন করছে। উন্নত বিশ্বে শুষ্কমরুভুমির মতো জায়গাতেও সেচ, সার ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়ায় চাষাবাদ করে সোনার ফসল উৎপাদন করে খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম হয়েছে। এশিয়ার অনেক দেশেই এখন কৃষিক্ষেত্রে গবেষণা আরও জোরদার করা হয়েছে। ফিলিপাইন, চীন, থাইল্যান্ডের মতো দেশগুলো তাদের কষি ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ প্রযুক্তিনির্ভর করে গড়ে তুলেছে। এ দেশগুলো বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে সক্ষম হচ্ছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষির গুরুত্ব: কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতি কাজে লাগাতে পালে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে আমূল পরির্বতন ঘটবে। কেননা বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। এ দেশের অধিকাংশ মানুষ এখনও কৃষিজীবি। বাংলাদেশের মোট জাতীয় আয়েল শতকরা ৩৮ ভাগ আসে কৃষি থেকে এবং রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাং ১৪ ভাগ আসে কৃষিজাত দ্রব্য রপ্তানি থেকে। এ ছাড়া শিল্প-কারখানায় কাঁচামাল সরবরাহের উৎস হিসেবেও বাংলাদেশে কৃষি খুব গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের কৃষির বর্তমান অবস্থা: বাংলাদেশ প্রকৃতির অপার স্নেহধন্য। এদেশের মাটি উর্বর এবং আবহাওয়া ফসলবান্ধব। রয়েছে পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক জলভান্ডার। এ ছাড়া বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাতও চাষাবাদের পক্ষে উনুকূল। এরপরও বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশের কৃষিদের কাছে আধূনিক কৃষি ব্যবস্থা প্রয়োগের মতো জ্ঞান ও অর্থ না থাকাই এ কারণ। ফলে জমি থেকে কাক্সিক্ষত ফসল আসছে না। তাই খাদ্যে স্বয়ংস্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য পূরণে ক্রমাগত ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে বাংলাদেশ।

আমাদের কৃষিকাজে বিজ্ঞান: আমাদের দেশেও আজ কৃষিকাজে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির ব্যবহার শূরু হয়েছে। জমি কর্ষণের জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে ট্রাক্টর। প্রকৃতির উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল না হয়ে পাম্প এবং গভীর ও অগভীর নলকূপের সাহায্যে পানি সেচ দেওয়া হচ্ছে। ক্ষেতের পোকা-মাকড় দমনের জন্যও সাহায্য নেয়া হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির । শস্য মাড়াই এবং ভাঙানোর কাজ হচ্ছে কলের সাহায্যে। ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে উন্নত মানের রাসায়ানিক সার। বীজ সংরক্ষণ ব্যবস্থাও হচ্ছে বৈজ্ঞানিক প্রণালিতে। পূর্বের এক ফসলি জমিতে এখন বিজ্ঞানের কল্যাণে তিনবার ফসল ফলানো হচ্ছে এ ছাড়া কৃষকদের মধ্যে বর্তমানে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে আগ্রহ লক্ষ করা যাচ্ছে। বেশি লাভবান হওয়ার আশায় এবং ঝুঁকিমুক্তভাবে চাষাবাদের লক্ষ্যে তারা বিজ্ঞানের নব নব আবিষ্কারকে কৃষিক্ষেত্রে কাজে লাগাচ্ছে।

কৃষিকাজে বিজ্ঞানের সফল প্রয়োগের উপায়: কৃষিভিত্তিক দেশ হিসেবে কৃষির উন্নতির উপরই আমাদের দেশের সামগ্রিক উন্নতি নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষিদের অজ্ঞতার জন্য বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি এবং যন্ত্রপাতি আমরা ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারছি না। তাই প্রথমেই দেশে শিক্ষার হার বাড়াতে হবে । কৃষকদের আধুনিক কৃষি পদ্ধতির সঙ্গে পরিচয় করাতে হবে। বর্তমানে বিভিন্ন সরকারি কৃষি সংস্থা বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষির উপর গবেষণা চালাচ্ছে। দেশের কৃষকদের এ পরীক্ষা-নিরীক্ষায় ফল জানিয়ে দেবার ব্যবস্থা কতে হবে এবং তারা যাতে বিজ্ঞানসম্মতভাবে কৃষিকাজ করতে পারে সেদিকে সক্রিয় দৃষ্টি দিতে হবে। কৃষিতে উচ্চতর শিক্ষা ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকদের আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। কৃষক সম্প্রদায়ের হাতে আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা কতে হবে। এ ক্ষেত্রে কৃষি সমবায় তৈরির উদ্যোগকে বেগবান করতে হবে। কেননা কৃষিপন্য উৎপাদন, ও সংরক্ষণ ও বিপণনের প্রতিটি ধাপে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে কৃষি সমবায় কার্যকর ভুমিকা রাখতে হবে। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে ব্যাপক উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। উপসংহার: বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ। কৃষির উন্নতির উপরই আমাদের দেশের সার্বিক সামাজিক উন্নতি নির্ভর করে। তাই কৃষিকে উন্নত করার স্বার্থে কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। সুজলা-সফলা আমাদের এই দেশের কৃষিতে বিজ্ঞানের জাদুর কাঠি ছোঁয়াতে পারলে খুলে যাবে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। কৃষির সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে গড়ে উঠবে সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।

চিকিৎসাক্ষেত্রে বিজ্ঞান - রচনা/প্রবন্ধ
Previus
বিজ্ঞানের জয়যাত্রা - রচনা
Next

Share This Post


Suggestion or Complain

সংবাদ শিরোনাম